ওয়াশিংটন ডিসির ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাত ধরে অনেক মানুষ নিজ নিজ গন্তব্যের পথে অবিরাম হেটে চলেছে।সবাই ভীষণ ব্যস্ত।বলতে গেলে তখনো শহরের ঘুম ভাঙ্গেনি অথচ মানুষ ছুটছে তার কর্মস্থলে।সে জন্যই বলা হয়ে থাকে নিউইয়র্ক আর ওয়াশিংটন শহর কখনো ঘুমায় না।পথে যেতে যেতেই হয়তো কেউ কেউ সেরে নিচ্ছে জরুরী যোগাযোগ।অনেকে কানে মোবাইল ধরে কথা বলছে আর হাটছে।কেউ কেউ প্রাতরাশ সেরে বাসায় ফিরছে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে।সেই সব পথচারিদের মধ্যে শেহজাদও আছে।শেহজাদ হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতে পোষ্টগ্রাজুয়েট করছে।ওয়াশিংটন ডিসিতে মেরিডিয়ান হিল পার্ক নামে যে পার্কটি আছে রোজ সকালে অন্য অনেকের মত শেহজাদও ওখানে হাটতে যায়।এটা ওর নিত্যদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে।বাসায় ফিরে গোসল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।সাধারণত ব্রেকফাষ্ট সে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনেই করে থাকে।
একাকী এই শহরে ক্যান্টিনের মত অনায়াসে খাবার পাওয়া তার জন্য কষ্টকর।বাইরের ক্যাফেগুলোতে যে খাবার পাওয়া যায় তার দাম অনেক।স্কলারশীপের টাকায় পড়তে এসে সব যদি খাবারের পিছনে ব্যয় করতে হয় তাহলে কি করে চলবে ভেবে সে বরাবরই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনকে প্রধান্য দেয়।পথে যেতে যেতে শেহজাদের মনে পড়ে বাবার কথা,মায়ের কথা আর একমাত্র আদরের বোন মিফরার কথা।যে শহরে সে জন্মেছিল তা আজ আর শহর নেই।হয়তো শহর ছিলোনা কোন কালেও।সে এক আজব শহর।যে শহরের রাস্তায় রাস্তায় পাগলা কুকুর ঘুরে বেড়ায় এবং মানুষ দেখলেই কামড়ে দিতে চায়। সেই সব কুকুরদের সাথে ওরা জন্ম থেকেই লড়াই করছে।সে লড়াই যেন কোন দিন থামবে না।সব থেকে ভয় হয় মিফরাকে নিয়ে।একমাত্র বোনটাকে সে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।বাবা মা আর বোনকে ফেলে এই দূর দেশে পড়তে আসতেও তার ভালো লাগেনি কিন্তু না পড়লেওতো চলবে না ভেবেই সে এসেছে।
একদিন দুদিন পর পর মিফরার সাথে ওর কথা বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু কথা বলা হয়ে ওঠেনা।যে খরচ তা সে কুলিয়ে উঠতে পারে না।পরিকল্পনা করে তাই মাসে একবার করে কথা বলে।বোনটা যেন ফোন রাখতেই চায় না।সারা মাসে জমে থাকা সব কথা সে তার ভাইকে বলবেই।শেহজাদেরও ভালো লাগে।বোনের সাথে কথা বলার মত আনন্দ সে আর কিছুতে পায় না।শেহজাদ স্বপ্ন দেখ এমন একটি ভুবনের যেখানে তার বোন আনন্দে হেসে খেলে বেড়াবে। রাস্তায় চলতে গিয়ে কারো কোন অসুবিধা হবে না।আকাশে অনবরত বোমারু বিমান ঘুরে বেড়াবে না।ডোরাকাটা পোশাকের সেনাবাহিনীর সদস্যরা ভারি অস্ত্র নিয়ে তাড়া করবে না।এই স্বপ্ন তার পুবর্পুরুষেরাও দেখেছে।সেই স্বপ্নের বীজ একটু একটু করে বংশপরম্পরায় শেহজাদের মধ্যেই অঙ্কুরিত হয়েছে।কিন্তু শুধু বীজ অঙ্কুরিত হলেইতো হবে না সেটিকে পরিচর্যা করার সুযোগ থাকতে হবে। শেহজাদ কিংবা তার মত অগণিত মানুষ সেই সুযোগ বঞ্চিত।পাগলা কুকুরেরা তাদের পিছনে রাত দিন ধাওয়া করে।তাদের সাথে লড়াই করে কোন মত ওরা বেচে আছে।বিশ্বের আর কেউ সেই সব পাগলা কুকুরের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নেয় না।শেহজাদেরা তাই নিরুপায়।
মেরিডিয়ান হিলপার্ক থেকে বেরিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে হাটছে শেহজাদ।চারদিকে নজর রাখছে।এ শহরটা তার বেশ ভালোই লাগে।কোথাও কোন অরাজকতা নেই,সবাই নিয়মের মধ্যে চলছে।
হঠাৎ শোরগোল উঠলো।মানুষ ছোটাছুটি শুরু করলো।শেহজাদ প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই সে দেখতে পেলো সত্যিকারের একটা পাগলা কুকুর মানুষকে তাড়া করছে।এই কুকুর আর শেহজাদের শহরের কুকুর আলাদা।এই কুকুর তার দাত ও নখ দিয়ে কামড়ে দিতে চায় কিন্তু শেহজাদের শহরের কুকুরেরা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ধেয়ে আসে। শেহজাদ দেখতে পায় রাস্তা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।শান্ত শহরটা মুহুর্তে সেই পাগলা কুকুরের ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছে।কুকুরটা যাকে পাচ্ছে তাকেই কামড়ে দিতে চেষ্টা করছে।কেউ কেউ ৯১১ এ ফোন করে সাহায্য চাইছে। শেহজাদ জানেনা ঠিক কতক্ষণের মধ্যে পুলিশ আসবে আর কুকুরটাকে আটক করবে।সব থেকে নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখলো শেহজাদ।এক মা তার তিন বছরের মেয়েকে ফেলে রেখেই ছুটে পালাচ্ছে কুকুরের ভয়ে।মেয়েটা ভয়ে কেদে উঠলো।সম্ভবত বিপদের আশংকা তার মনেও ছিলো।সেও হয়তো কুকুরটাকে দেখে ভয়ে শিউরে উঠেছিল।ওই বয়সেও সে বুঝতে পেরেছিল পাগলা কুকুরটা তাকেও কামড়ে দিবে।
শেহজাদের মনে পড়ে যায় মুঘল সম্রাট জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের কথা।একবার তিনি ভ্রমনে বেরিয়েছিলেন।হঠাৎ শহরের রাস্তায় এক পাগলা হাতি ছুটে আসলো।ভয়ে যে যেদিকে পারে ছুটে পালালো।রাস্তায় পড়ে রইলো এক মেথরের ছেলে।ছদ্মবেশী সম্রাট বাবর দেখলো পাগলা হাতিটি বাচ্চাটিকে পিষে মেরে ফেলবে।তিনি জীবনের ঝুকি নিয়ে হাতির আঘাত সহ্য করে বাচ্চাটিকে বাঁচালেন।তখন আশেপাশের অনেকেই বললো তুমিকি পাগল নাকি?একটা মেথরের ছেলেকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন দিতে চলেছিলে।তুমিকি বেওকুব নাকি!ছদ্মবেশী সম্রাট বাবুর তাদের ওই সব কথায় কান দেননি।তিনি বিপদের দিনে একটি শিশুকে উদ্ধার করেছেন এটাই অনেক বড় ব্যাপার।শেহজাদ সম্বিত ফিরে পেলো।সে দেখতে পেলো বাচ্চা মেয়েটি ভয়ে চিৎকার করে কাদছে।আসে পাশে অনেক মানুষ ছোটাছুটি করছে কিন্তু কেউ ওকে নিতে এগিয়ে আসছে না।পাগলা কুকুরটা ক্রমেই ওর কাছে চলে আসছে।শেহজাদ নামের পচিশ বছরের যুবকটি এক দৌড়ে বাচ্চাটির কাছে পৌছে গেলো।চিল যেমন ছো মেরে শিকার ধরে আকাশে উড়ে যায় শেহজাদ অনেকটা সেভাবেই বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো।এক দৌড়ে রাস্তার ধারে দেয়ালের কাছে চলে গেলো।পাগলা কুকুরটিও তখন ওর পিছনে ধাওয়া করলো।শেহজাদ বাচ্চাটিকে দেয়ালের উপর বসিয়ে দিয়ে ফিরে তাকালো কুকুরটির দিকে।তার পর সুযোগ বুঝে কুকুরটিকে লাথি মেরে ফেলে দিলো।এর পর কুকুরটিকে আর কোন সুযোগ দিলো না।সে কয়েক দফা লাথি মেরে কুকুরটিকে ঘায়েল করে ফেললো।কয়েক মিনিটের মধ্যেই কুকুরটি নিস্তেজ হয়ে পড়লো এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো।
বিচিত্র এই পৃথিবী আরো একবার কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো শেহজাদের।কিছুক্ষণ আগে যে পাগলা কুকুরটির ভয়ে সবাই পড়িমরি করে পালিয়ে যাচ্ছিলো তারাই সবাই একে একে এসে জড় হতে লাগলো।শহরে পাগলা কুকুর নেমেছে এই সংবাদ আগেই ছড়িয়ে পড়েছিলো সুতরাং আসেপাশে সাংবাদিকেরাও চলে এসেছিল।তারা যখন দেখলো এক যুবক পাগলা কুকুরটিকে মেরে পরিবেশ শান্ত করেছে তখন তারা নির্ভয়ে ফিরে এলো।শেহজাদকে ঘিরে তখন হাজারো জনতা।সবাই তাকে বাহবা দিতে লাগলো।সিএনএন এর সাংবাদিক রডরিক মায়ার ভিড় ঠেলে শেহজাদের সামনে এসে দাড়ালো।সে তখনো হাপাচ্ছে। দেখেই বুঝা যায় সে নিশ্চই বেশ দৌড়েছে।কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সে বললো আপনার সাহস আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।আপনি যেভাবে পাগলা কুকুরটির সাথে লড়াই করে বাচ্চাটিকে রক্ষা করেছেন পাশাপাশি সবাইকে ভয় থেকে বাচিয়েছেন তাতে আপনাকে নিয়ে আমাদের গর্ব হয়।আমি সিএনএন থেকে এসেছি।আমরা চাই আপনাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করবো সিএনএন এ।আপনার নাম কি বলুন? আমরা আপনার নাম সহ প্রতিবেদন করবো “দুঃসাহসী এক আমেরিকান যুবক কর্তৃক পাগলা কুকুরের হাত থেকে এক শিশুর প্রাণ রক্ষা পেলো”।চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে যাবে।আপনার মত আমেরিকানদের জন্যই আমেরিকা আজ বিশ্বে সব থেকে শক্তিশালী হতে পেরেছে।আপনারাই স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছেন “উই উইল মেক আমেরিকা গ্রেট”
শেহজাদ চুপ করে সিএনএন এর সাংবাদিক রডরিক মায়ারের কথা শুনছিলো।সে থামলে শেহজাদ বললো: আমি আমেরিকান নই! আমি ফিলিস্তিনি।আর আমরাতো জন্ম থেকেই কুকুরদের সাথেই লড়াই করে আসছি। সুতরাং এমন পাগলা কুকুরের সাথে লড়াই করাটা আমাদের জন্য কঠিন কিছু না”। রডরিক মায়ার খসখস করে নোটবুকে কিছু লিখে নিলেন।শেহজাদের ওসবে মন নেই।সে দেখলো রডরিকের সাথে আসা ক্যামেরাম্যান ওর কিছু ছবিও তুলে নিলো।মুহুর্তেই ভীড় কমে গেলো।যে যার বাসায় ফিরে গেলো।শেহজাদও ফিরলো।গোসল করে বেরিয়ে পড়লো বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে।ডক্টর রুথাব আজ একটা গুরুত্বপুর্ন ক্লাস নিবেন বলে ও একটু আগে আগেই বেরিয়েছে।ক্যাফেটেরিয়াতে বসে নাস্তা খেতে খেতে টিভিতে সকালের সংবাদটাও দেখে নেওয়া যাবে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের সংবাদ জানতে খুব ইচ্ছে করে।বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাফেটেরিয়াতে বসে সকালের নাস্তা খেতে খেতে টেলিভিশনের দিকে তাকালো।তখন সংবাদ শুরু হবে। ব্রেকিং নিউজে চোখ আটকে গেলো শেহাদের।সিএনএন নিউজ করেছে “মুসলিম টেরোরিষ্টদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না অবুঝ পশুরাও! এবার ওয়াশিংটন ডিসির ব্যস্ত সড়কে খুন হলো এক নিরীহ কুকুর!!” ব্রেকং নিউজের শিরোনামের সাথে সাথে শেহজাদের একটি ছবিও দেখানো হচ্ছে।
নাস্তা শেষ করা হলো না।মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্চই আমেরিকান পুলিশ তাকে গ্রেফতার করবে।তার পর যে অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হবে মনে মনে সেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো শেহজাদ।ইচ্ছে করছে ইয়োলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে উদ্ভ্রান্তের মত হাটবে।মনে পড়ছে বাবা মাকে।মনে পড়ছে একমাত্র বোন মিফরাকে।কুকুরদের আঘাতে যদি বাড়ির টিভিটা ভেঙ্গে না গিয়ে থাকে তবে মিফরাও কি এই সংবাদটা দেখবে না?আর কি কোন দিন দুই ভাই বোনের দেখা হবে না?শেহজাদ এসব ভাবছে আর হাটছে।অবাক বিস্ময়ে সে হতবাক হয়ে গেছে।কয়েক মুহুর্ত আগে যে মানুষটি তার ভালো কাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো সেই মানুষটিই তাকে টেরোরিষ্ট বানিয়ে দিয়েছে।মুসলিমদের জন্য টেরোরিষ্ট শব্দটা যেন পদ পদবীর মত হয়ে গেছে।শেহজাদের খুব আফসোস হয়।নিজ বাসভূমি ফিলিস্তিনে তারা নিরাপদ নয়,বিশ্বের কোথাও তারা নিরাপদ নয়।তারা মুসলিম,তাদের নামের আগে আমেরিকানরা টেরোরিষ্ট শব্দটি ব্যবহার করতে ভালোবাসে।মোবাইলটা বের করে একমাত্র বোন মিফরার সাথে কথা বলবে বলে মনস্থির করে।মোবাইল স্ক্রীনে নিজের চেহারাটাই ভেসে ওঠে।সে মনে মনে ভাবে যাকে দেখছি সে নাকি টেরোরিষ্ট!
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮
জাজাফী