আমি ছাত্র রাজনীতির পক্ষে নাকি বিপক্ষে? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিতে গেলে আমি হয়তো বলবো আমি ছাত্র রাজনীতির পক্ষে। তবে মনে রাখতে হবে এই রাজনীতি কিন্তু ছাত্রলীগ,ছাত্রদল,ছাত্রশিবির,ছাত্র মৈত্রী সহ রাজনৈতিক প্রপাগান্ডায় গড়ে ওঠা ছাত্র রাজনীতি নয়। ছাত্ররাজনীতির পক্ষে শুনেই অনেকে আমার উপর রাগ করবেন এবং আমাকে মনে মনে বা সদরে গালমন্দও করতে পারেন। যেখানে অসংখ্য মানুষ ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে সেখানে আমি কেন এমন কথা বলছি? বুয়েটের সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বুয়েটের যে সব শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধে সব রকম ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করেছে এবং নিজ নিজ ফেসবুক টাইমলাইনে স্ট্যাটাস দিয়েছে ”আমি অমুক, বুয়েটে লেভেল-৩,টার্ম-১ এর একজন শিক্ষার্থী, আমি বুয়েট ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে কোনো প্রকার সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি পুনরায় প্রতিষ্ঠা হোক চাই না”। তাদের এই মতামতকে আমি সম্মান করি এবং আমি তাদের দাবীর সাথে একমত পোষণ করছি।
আমি তাদের সাথে একমত পোষণ করছি এ কারণে যে আমি দেখেছি বুয়েটে রাজনীতির কারণে বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। শুধু আবরার ফাহাদ নয় আরও প্রাণ ঝরেছে। মনে পড়ে সাবেকুন্নাহার সনির কথা? সেও কিন্তু বুয়েটের তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির বলি হয়েছিল।২০০২ সালের ৮ জুন বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের (৯৯ ব্যাচ) লেভেল ২, টার্ম ২–এর মেধাবী ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলির মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। শোকে, বেদনায় স্তব্ধ হয়ে যায় সমগ্র বাংলাদেশ। এ দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে এমন কলঙ্কজনক ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।২০০২ সালের ৮ জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বুয়েট ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ লড়াইয়ের এক ময়দান। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠেছিল পরস্পরের অতি আপনজন, সহযোদ্ধা। এই আন্দোলন আমাদের শিখিয়েছিল সংগ্রামের পথেই প্রকৃত বন্ধুত্ব রচিত হয়। আবার এই আন্দোলনে দেখেছিলাম, একটা নৈতিক আন্দোলন দমনে রাষ্ট্র কত নির্মম হতে পারে! এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের পক্ষে সেই দিনগুলো কল্পনা করাও কঠিন।
মনে পড়ে, ২০০২ সালের মিড-টার্মের পরে প্রথম দিনটি ছিল ৮ জুন। চলছে বিশ্বকাপের খেলা। খেলা দেখার জন্য স্বেচ্ছায় ছুটি নিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। বেলা পৌনে একটার দিকে বুয়েটের বিশাল অঙ্কের টেন্ডারকে কেন্দ্র করে মোকাম্মেল হায়াত খান মুকির নেতৃত্বে ছাত্রদল বুয়েটের একটা সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয় ঢাবির এসএম হলের আরেক সন্ত্রাসী টগর গ্রুপের সঙ্গে। অবিরাম গুলিবর্ষণের মধ্যে পড়ে আহসান উল্লাহ হলের সামনে সাবেকুন্নাহার সনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
ওই দিন রাতেও খুনিরা অবস্থান করছিল বুয়েটের রশীদ হলে। রাতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী মিছিল করে গিয়ে রশীদ হল ঘেরাও করে ফেলে। প্রশাসনকে জানানো হয় খুনিদের গ্রেপ্তারের জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পরে পুলিশসহ প্রশাসন আসে রশীদ হলে। আশ্বস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সেখানে মঞ্চস্থ হয় আরেক নাটকের। পুলিশ এসে আন্দোলনকারীদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে খুনিদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। আন্দোলন দমনের কৌশল হিসেবে পরদিন ৯ জুন বুয়েট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এই বন্ধের মধ্যেও সারা দেশে আন্দোলন অব্যাহত থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। খুনিদের বিষয়ে প্রশাসন নমনীয় থাকলেও আন্দোলনকারীদের বিষয়ে বেশ সোচ্চার হয়ে ওঠে তারা। বোনের হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন করার অপরাধে (!) বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ায় স্থাপত্য বিভাগের বিজয় শংকর তালুকদার বিশু, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সহসভাপতি সুব্রত সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থীকে হল থেকে বহিষ্কারসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়। প্রশাসন ভেবেছিল, এভাবে শাস্তি দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে ভীতি তৈরি করতে হবে, যেন পরে আর আন্দোলন সংগঠিত না হয়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
এই রাজনীতি বুয়েটের ছাত্র ছাত্রীদের জীবনে দুর্বিষহ যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। কেড়ে নিয়েছে জীবন, কেড়ে নিয়েছে সুন্দর সময়,উজ্জল ভবিষ্যত। তাহলে তারা কেন সেই রাজনীতিকে সমর্থন করবে? আর আমিইবা কেন এই নষ্ট রাজনীতিকে সমর্থন করবো। যদি এই রাজনীতি তাদের জীবনে ভালো কিছু বয়ে আনতে পারতো তাহলে আমি অবশ্যই তা সমর্থন করতাম।
আমি যেহেতু তাদের দাবীর সাথে একমত পোষণ করছি তাহলে দেখা যাচ্ছে আমি আমার নিজের কথাতেই আটকে যাচ্ছি। কারণ শুরুতে আমি বলেছি আমি ছাত্র রাজনীতির পক্ষে! তাহলে বিষয়টা কেমন দাঁড়াচ্ছে? আমি ছাত্র রাজনীতি চাই আবার চাই না এটাতো বুমেরাং হয়ে গেলো। নিজের স্টেটমেন্টই নিজের বিপক্ষে চলে গেলো। বিষয়টা একটু অন্যরকম। এখন আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে যে ছাত্ররাজনীতি আছে আমি পুরোপুরি তার বিপক্ষে। ছাত্রলীগ,ছাত্রদল,ছাত্রশিবির,ছাত্রমৈত্রী সহ নানা নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যে সবা ছাত্র (অছাত্র বলাই ভালো) সংগঠন তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এর পুরোপুরি বিরেধী আমি। দলীয় সার্থ ছাড়া এই সব ছাত্র সংগঠন কিছুই করে না। আর এটা করতে গিয়ে তারা দমন,নিপীড়ন,হল দখল থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করে না। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন সেই দলের ছাত্র সংগঠন রাজত্ব করে। অন্য ছাত্রসংগঠন তখন কোণঠাসা হয়ে থাকে। আর এর মাঝে পড়ে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা বিপাকে পড়ে। তারা এসেছিল পড়াশোনা করতে,হতে চেয়েছিল দেশের জন্য অমূল্য সম্পদ। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির যাতাকলে পড়ে তাদের সব স্বপ্ন বিনষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং এই সব অপরাজনীতি বন্ধ হোক এটা আমি চাই।
তাহলে আমি যে বললাম ছাত্র রাজনীতি চাই সেটা কিভাবে? আসলে আমি চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র থাকবে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ার বাইরে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক। তারা কাজ করবে ছাত্রদের কল্যাণে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোথাও কোনো সমস্যা থাকলে তারা সেটা সম্মিলিত ভাবে মোকাবেলা করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের উন্নয়ন,শিক্ষার মানোন্নয়ন,খাবারের মানোন্নয়ন থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয়ে তারা থাকবে ঐক্যবদ্ধ। তারা কারো তাবেদারী করবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীর দাবী দাওয়া তারা সম্মিলিত ভাবে আদায় করে নিবে। এর বাইরে তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে কল্যাণকর হয় এমন বিষয়ে সোচ্চার থাকবে। অন্যায় দেখলে সম্মিলিত ভাবে প্রতিবাদ করবে। যে কোনো অনিয়ম তারা রুখে দিতে পারে সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। তার বদলে এখন যে ছাত্র রাজনীতি চলছে তা কেবল দলের প্রভাব বিস্তার ছাড়া তাদের আর কোনো লক্ষ্য নেই। তারা ছাত্রদের কল্যাণ হয় এমন কিছুই করে না। বরং উল্টো হলের খাবার থেকে শুরু করে সিট অব্দি খেয়ে ফেলে। এই সব দলীয় অপছাত্র রাজনীতির কবলে পড়ে কত মেধাবী প্রাণ দিয়েছে তা কারো অজানা নয়। সুতরাং কোনো ক্যাম্পাসেই এই ধরনের অপরাজনীতি থাকতে পারে না। এটা সমর্থনও করতে পারি না।
হ্যা এটা আমি অস্বীকার করবো না যে আমাদের ভাষা আন্দোলন,মুক্তিযুদ্ধ সহ অন্যান্য বড় বড় আন্দোলনে এদেশের ছাত্রদের ভূমিকা ছিলো অনেক বেশি। কিন্তু সেই সময়ের ছাত্র রাজনীতির সাথে এখনকার ছাত্র রাজনীতি কোনো ভাবেই মেলানোর সুযোগ নেই। ছাত্র নেতাতো তার হওয়ার কথা যে ছাত্র হিসেবে সেরা, মানুষ হিসেবে সেরা। এই যে সাত বার ফেল করা একজন যখন ছাত্র নেতা হয়,ছাত্রদের অভিভাবক হয় তখন এর চেয়ে হাস্যকর আর কিছু থাকতে পারে না। যে নিজে সাত বার ফেল করে আদু ভাই হয়ে ছাত্রনেতা হয়ে ছড়ি ঘোরায় সে কোন মুখে বলে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নেই বলে শিক্ষার পরিবেশ নেই! এর চেয়ে হাস্যকর কোনো কথা আমার জানা নেই। সে যদি নিজে সময় মত পাশ করতো, বিভাগের সবচেয়ে সেরা ছাত্র হতো, তবে তার কথা কিছুটা হলেও মানা যেত যে ছাত্র রাজনীতি তাকে সেরা ছাত্র বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যে নিজেই ফেল করতে করতে রবার্ট ব্রুসকেও হার মানিয়ে দিয়েছে সে কোন মুখে এরকম কথা বলে? তারতো লজ্জা নেই। নির্লজ্জ বেহায়া না হলে এমন কথা কেউ বলতে পারে না। আমি আমার এই জীবনে ছাত্র রাজনীতি করে ভালো ফলাফল করেছে,দেশের কল্যাণে কাজ করেছে এমন কাউকে দেখিনি। তাহলে আমি সেই রাজনীতি কিভাবে সাপোর্ট করতে পারি যা ছাত্রদের কল্যাণের বদলে অকল্যাণ নিয়ে আসে।
আমি বরং দেখেছি কৃষকের ঘরে জন্ম নিয়ে ছাত্ররাজনীতিতে নাম লিখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এই সব লুটেরাদের কোনো ক্যাম্পাসেই ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়। সে কারণে আমি দেশের সব ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হোক এটা চাই। বিশ্ববিদ্যাল পড়াশোনার জায়গা। এখানে রাজনীতি করতে কেউ আসে না। যাদের শখ রাজনীতি করা তাদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক যেখানে তারা সারাদিন শুধু রাজনীতি করবে। সেই ক্যাম্পাসে তারা মিছিল মিটিং যা খুশি করুক। সেখানে তারা শিখুক কিভাবে হল দখল করতে হয়, কিভাবে টেন্ডারবাজি করতে হয়। আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পড়তে চাই। সেখানে অপড়ুয়াদের কোনো জায়গা নেই। বুয়েট থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হোক এই সব তথাকথিত লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি মুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠুক শুধু মাত্র পড়াশোনা,গবেষণা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের আবাসভূমি।
২ এপ্রিল ২০২৪