একটু ভেবে দেখুন হয়তো আপনার ঘরের পুব দিকের জানালাটা খুললেই ফুরফুরে বাতাস আপনাকে মুহুর্তেই শীতল করে দেয়।বাইরে তাকাতেই আদিগন্ত খোলা মাঠ,নীল আকাশ।রোজ সকালে একবার করে আপনার ঘুম ভাঙ্গে জানালা দিয়ে আসা সুযের্রর মিষ্টি আলোয়।
কিন্তু সেই ভোরের সুর্যটা যখন মিষ্টি আলো ছড়াতে ছড়াতে পুব আকাশে উকি মারে তখন কখনো কি আয়োজন করে সেটার দিকে তাকিয়েছেন? কিংবা হতেও পারে আপনার রুমটি পশ্চিম দিকে খোলা জানালা ধরে তাকালেই রোজ একটু একটু করে সুযের্র তলিয়ে যাওয়া দেখতে পান। পুরো পৃথিবীকে অন্ধকার করে দিয়ে সে হারিয়ে যায়।
তখন নিশ্চই আপনি আয়োজন করে সুর্যর হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখেন নি। কিন্তু সেই আপনিই কত আয়োজন করে কুয়াকাটাতে যাচ্ছেন সুয উদয় অস্ত দেখতে কিংবা কক্সবাজার যাচ্ছেন সুযের ডুবে যাওয়া দেখতে।
আকাশেতো একটাই সুয, সেই সুযটাইতো আপনার ঘরের জানালা বরাবর উদয় হয়ে দিন শেষে অস্ত যায়। আবার সেই সুযটাইতো কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের ওপাশে উদয় হয়ে অস্ত যায়। কিন্তু আপনার জানালায় উকি দেয়া সুর্যটা আপনাকে টানেনা, কিন্তু কুয়াকাটার সুয আপনাকে টানে।
না পাওয়ার পিছনে ছুটতেই আমরা ভালবাসি।যেটা আপনা আপনি পদতলে লুটিয়ে পড়ে থাকে আমরা সেটাকে অবহেলা করি, কখনোই তুলে নেই না।
ওপারেতে যত সুখ আমার বিশ্বাসকে পুজি করেই আমাদের বেঁচে থাকা।সুদুর ইতালির ভেনিস নগরীর কংক্রিটের সৌন্দয আমাদের মোহাচ্ছন্ন করে কিন্তু গাজিপুরের শালবাগান আমাদের টানেনা।ভোলার মনপুরা দ্বীপ আমাদের টানেনা।
আপনার খুব বিপদের সময় হয়তো কাউকে ফোন করেছেন একবার দুবার বার বার। কিন্তু ওপাশের ব্যক্তিটি ফোন রিসিভ করছেনা। এমনকি কেটেও দিচ্ছেনা।আপনার খুব বিরক্ত লাগছে। মনে মনে ভাবছেন সে আপনাকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখছে, অবহেলা করছে। ভাবছেন তার সাথে সম্পর্কই ছিন্ন করবেন।
প্রকৃত পক্ষে সেটা নাওতো হতে পারে।আধুনিক এই যুগে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। কেউ কোন মত খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে, আবার কেউবা পাহাড় সমান সম্পদ থাকার পরও হিমালয়ের মত উচু হওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে।
ব্যাস্ততাই আজ আমাদের অনেক কিছু থেকে বিমুখ করে রেখেছে। সে জন্যই হয়তো আপনি আমি যাকে ফোন করছি তার নজরেই আসছেনা যে কেউ একজন তাকে ফোন করেই যাচ্ছে।
ব্যস্ততা যে মানুষকে কতটা বেখেয়াল করে দেয় তার অনেক উদাহরণ দেয়া যায়।ওয়াশিংটন মেট্রো রেল স্ট্রেশান।সকাল থেকেই হাজার হাজার কর্মব্যস্ত মানুষের ভীড়। রেল ক্রসিংএর জন্য যে ওভার ব্রিজটা আছে তার সিড়ির পাশেই দাড়িয়ে ছিলাম।অপেক্ষা ট্রেন আসার জন্য।
একজন বয়স্ক লোক একটা হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে এসে থামলো সিড়ির পাশে। হুইল চেয়ার থেকে একজনকে ধরে ধরে সিড়ির পাশে বসিয়ে দিল।লোকটার মাথায় একটা সাদামাটা ক্যাপ।হাতে একটা বেহালা।চোখে একটা সাদামাটা চশমা। হতেও পারে লোকটা অন্ধ। যে তাকে নামিয়ে দিতে এসেছিল সে হুইল চেয়ারটা ঠেলে ঠেলে চলে গেল।
বেহালা হাতে লোকটি একে একে সুর তুলতে লাগলো। মাথার ক্যাপটি সামনে মেলে ধরলো।বুঝলাম নেহায়েত কোন ভিখারী। ওই দেশে ভিক্ষুকও কোন না কোন সৃজনশীলতা দেখিয়ে তবেই ভিক্ষা করে।হাজার হাজার মানুষ ব্যস্ত হয়ে ছুটে চলেছে নিজ নিজ গন্তব্যে। বেহালা বাদক একের পর এক সুর তুলছে।কখনো বেদনার, কখনো আনন্দের।কারো সেদিকে তাকাবার সময়ই যেন নেই।
একজন মধ্য বয়সী মহিলা যেতে যেতে তার ক্যাপের দিকে এক ডলার ছুড়ে দিল।তার পর আরো অনেক ক্ষন।আমার ট্রেনে ওঠা হলোনা। তার সুর আমাকে মুগ্ধ করলো, তার চেয়েও আমি বেশি কৌতুহলী ছিলাম তার ক্যাপে কত ডলার পড়ে সেটা দেখার জন্য।
একটা ছোট্ট বাচ্চা অনেক ক্ষণ তার দিকে অপলোক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।কত মানুষ গেল কত মানুষ আসলো কিন্তু তার সেই সুর কারো আমলেই আসলোনা। কেউ তার দিকে গুরুত্ব দিয়ে তাকালানা পযর্ন্ত। সবার কাছে তার বেহালার সুর যেন কোন ট্রামের সাইরেনের মতই যে বাজছে বাজুক কানে এসে লাগুক তাতে কার কি আসে যায়।
দিন শেষে সেই বেহালাবাদকের ক্যাপে ৩২ ডলার জমা হলো।কিছুক্ষণ পর যে তাকে নামিয়ে দিয়ে গেছিল সে আবার ফিরে আসলো।
নাহ তার সাথে কোন হুইল চেয়ার নেই। বেহালা বাদক এবার নিজেই উঠে দাড়ালেন।তার হাত থেকে বেহালাটিও লোকটি নিজে নিয়ে নিল।চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেলার পর আমি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলাম একটু আগেই বেহালা বাজিয়ে ভিক্ষা করা লোকটিকে।
ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থেকেও যাকে আমি চিনতে পারিনি এবং আমার মত হাজার হাজার মানুষ চিনতে পারেনি সেই তাকেই মাত্র এক মিনিটেই চিনতে পারলাম। তিনি আর কেউ নন, তিনি বিশ্বের সবর্কালের শ্রেষ্ঠ বেহালা বাদকদের একজন, জোসুয়া বেল!!!
যার এক একটা কনসার্টে যেতে হলে সবর্নিম্ন টিকেটের দাম থাকে ১০০ ডলার! সেই জোসুয়া বেল যখন একটা ব্যস্ত মেট্রো স্টেশানের ওভার ব্রিজের নিচেয় বসে ভিক্ষুকের মত ভিক্ষার জন্য একই সুর বাজিয়ে ছিলেন তখন মানুষের তার দিকে নজর দেবার সময় ছিলনা।সারা দিনে যার আয় হয়েছে মাত্র ৩২ ডলার।
আমরা আসলে এরকমই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে ব্যস্ততার কারণে জীবনের অনেক কিছু আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
সাধারণ সময়,অনুপোযোগি স্থান আর অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিই জোসুয়া বেলকে সবার নজরে উপেক্ষিত থাকতে হয়েছিল। তিনি সেদিন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের গবেষণার জন্য মেট্রো স্টেশানে ভিখারির মত ভিক্ষা করছিলেন!
পত্রিকার পাতায় পাতায় যখন খবরটি ছাপা হলো তখন কতজনেই না আফসোস করলো।যাকে টাকা দিয়েও কাছে পাওয়া যায়না সেই জোসুয়া বেল নিজে এসে ভিক্ষুকের বেসে দুয়ারে দাড়িয়েছে অথচ তাকে কেউ চেনেনি।আমার বন্ধু ডকোটা গয়ো নিজেও আফসোস করেছিল পরের প্রায় তিন মাস ধরে।সেও নাকি সেদিন পাশ কাটিয়ে চলে এসেছিল!
এভাবেই হয়তো আমাদের প্রত্যেকের জীবন থেকেই কত গুরুত্বপুর্ন সময় হারিয়ে যায়,কত গুরুত্বপুর্ন মানুষ হারিয়ে যায় আমরা খোঁজও পাইনা।তাই জীবনের সব থেকে গুরুত্ব পুর্ন সময় হচ্ছে এখন এই সময়টা। সব চেয়ে গুরুত্বপুর্ন মানুষ হচ্ছে এই মুহুর্তে সামনে যে আছে তিনি। এবং সব থেকে গুরুত্বপুর্ন কাজ হচ্ছে যে কাজটি শুরু করেছি সেটা।
না পাওয়ার পিছনেই আমরা অবিরাম ছুটে চলেছি।মরিচিকা জেনেও সেটাকে অনুসরণ করছি। অথচ যা আমার পায়ে এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে সেটাকে গুরুত্বই দিচ্ছিনা।
বাংলাদেশে হাতে গুনে হলেও অন্তত দশজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ আছেন তাদের পাশ কাটিয়ে আমরা তাই অন্য কাউকে বড় কোন পদে বসিয়ে দিচ্ছি আবার যখন জল ঘোলা হচ্ছে তাকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধা করছিনা।
জানালা খুললে যে সুযকে উদিত এবং অস্ত যেতে দেখি সেটার দিকে আমরা ফিরেও তাকাইনা অথচ ঠিকই সেই একই সুযকে উদয় অস্ত দেখতে হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে কুয়াকাটা থেকে পাতায়া বীচে যেতেও আমাদের সময় লাগেনা।
দূরের সৌন্দর্য আমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে কাছের সৌন্দযকে নেহায়েত ধুসর মনে হয়।যে পান্ডুলিপিকে জীবনানন্দ “ধূসর পান্ডুলিপি” আখ্যা দিয়েছিলেন সেটি যে আসলে ধুসর নয় বরং হীরের মত উজ্জল ঠিক তারই মত আমরাও অহেতুক মোড়ক লাগানো সৌন্দর্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে প্রকৃত সৌন্দযকে দেখার সুযোগ পাচ্ছিনা।চোখের আড়ালেই থেকে যাচ্ছে প্রিয় কোন স্থান,প্রিয় কোন মানুষ,প্রিয় কোন স্মৃতি।
………………
৩১ মার্চ ২০১৬,দৈনিক ইত্তেফাক।