সুদূর অতীতে এই দেশে এসে মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন চৈনিক পরিব্রাজক ফা হিয়েন। মরোক্কো থেকে নানা দেশ ঘুরে বাংলাদেশে এসে মুগ্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন ইবনে বতুতা। কী আছে এই বাংলাদেশে? কী দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি?এখনকার অনেক বাঙ্গালীইতো আজকের বাংলাদেশে কোন সুখ খুঁজে পান না,এ দেশের কোন সৌন্দর্যই নাকি তাদেরকে আর টানেনা।
তারা ছুটে যায় ইতালীর ভেনিস নগরীতে, যে নগরী আজন্মকাল অবগাহন করছে গলাঅব্দি পানিতে।তারা ছুটে যায় সিডনিতে যেখানে কংক্রিটের দেয়াল চারদিকে প্রাণহীন তামাটে সৌন্দর্য বিলিয়ে চলেছে।
তারা ওখানে সুখ খুঁজে পায় কিন্তু সুখ খুঁজে পায়না বাংলার সবুজে ঘেরা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে। তাহলে ইবনে বতুতা কী পেয়েছিলেন এই সবুজ জমিনে। “কিতাবুর রেহালা” নামে তার সেই বিখ্যাত ভ্রমন কাহিনীতে তিনি বাংলাকে ধনসম্পদে পরিপুর্ণ এক বেহেস্তের সাথে তুলনা করে গেছেন। কবি গুরু লিখেছিলেন “ সাতকোটি সন্তানেরে হে বঙ্গ জননী/রেখেছ বাঙ্গালী করে মানুষ করোনি”।
কিন্তু কবি গুরু বেঁচে থাকলে হয়তো এই কথাটিও লিখতেন না। আমরাতো ক্রমে ক্রমে আমাদের বাঙ্গালীত্বও হারিয়ে ফেলতে বসেছি।আমাদের বাঙ্গালীত্ব ফুটে ওঠে কেবল ফেব্রুয়ারিতে,বইমেলায় আর পহেলা বৈশাখে।আমরা তখন একুশ ফেব্রুয়ারিকে আট ফাল্গুন বলতে ভালবাসি। কিন্তু তার পর আমাদের বাঙ্গালীত্বকে আমরা বিসর্জন দিই।
আমরা বাবাকে ড্যাডি বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। আমরা মাতৃভাষাকে যে যেভাবে পারছি বিকৃত করছি। তবে এখনো মাতৃভাষা প্রীতি আছে এমন মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।স্কুলের শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তরে স্বর্গর মত ছোট্ট ছেলেটিও দেশ প্রেমের অতুলনীয় সংজ্ঞা দিতে পারে।
একজন কম বয়সী ছেলে যখন বলে “ যখন দেশের কোন ভাল সংবাদে মনের মধ্যে আনন্দ হয় আর খারাপ সংবাদে ব্যাথা লাগে তখন বুঝতে হবে ঐ ব্যক্তির মধ্যে দেশ প্রেম আছে। দেশ প্রেম রাজনৈতিক নেতাদের মত মাইকে গলা ফাটিয়ে বলার মত কিছু নয় যে আমি দেশ প্রেমিক।
দেশ প্রেম হলো নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করা”। যে মানুষ এরকম ভাবতে পারে তারাই আমাদের ভবিষ্যত এবং উজ্জল ভবিষ্যৎ।ওদের দিকে তাকালে আমাদের আশার প্রদীপ আবার জ্বলে ওঠে।
প্রতি নিয়ত যারা দেশ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে আর বলে বেড়ায় এ দেশে কিছুই নেই,এ দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, তাদের জন্যতো বহুকাল আগে আবদুল হাকিম লিখেছিলেন “যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি”। বিদেশী ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে আমরা বরাবরই জোর দিয়ে থাকি কিন্তু সে ক্ষেত্রে অবশ্যই মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিতে হবে।ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একাধিক ভাষায় পন্ডিত তাই বলে তিনি মাতৃভাষা পরিত্যাগ করেন নি।
প্রয়োজনের বাইরে কেন বিদেশী ভাষা ব্যবহার করতে হবে। এর যৌক্তিকতাইবা কতটুকু। ইংরেজী মাধ্যমে পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা স্কুলে যথেষ্ট ইংরেজীর চর্চার সুযোগ পায় তাহলে বাসায় বা বন্ধুদের আড্ডায় কেন ইংরেজীতেই কথা বলতে হবে তা আমাদের বোধগম্য নয়।
আর তাই অনেক ইংরেজী মাধ্যমের ছেলে মেয়েদের বাংলা বলা শুনলে মনে হয় বাংলা তাদের দ্বিতীয় ভাষা। আজকে আমাদের স্বদেশ প্রীতি নিয়েও কথা উঠছে। দেশে এখন দুই ধরনের মানুষের বসবাস ধনী এবং গরীব।
যারা এক সময় মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে ছিল তারা ক্রম ব্যায়বর্ধমান সময়ের সাথে সাথে গরীব শ্রেণীতে নেমে গেছে। আর ধনীরা ক্রমান্বয়ে আরো ধনিতে পরিণত হচ্ছে। আর সেই শ্রেনীভুক্তদের মধ্যেই দেশ প্রেম এবং বাংলা প্রীতির অভাব প্রবল ভাবে লক্ষ্যনীয়। তারাই সব থেকে বেশি হতাশ এ দেশ নিয়ে। আমাদের খুব জানতে ইচ্ছে করে যে দেশটাকে আপনাদের ভবিষ্যৎহীন মনে হয় সে দেশে কেন থাকেন আপনারা। আবদুল হাকিমের ভাষায় “ স্বদেশের প্রেম যার মনে ন জোয়ায়/নিজ দেশ ছাড়ি কেন বিদেশে ন যায়”।
আমরা হয়তো সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই বাংলার সৌন্দর্য খুঁজে পাইনি। কিংবা সেই সৌন্দর্য দেখার মত চোখ আমাদের নেই। আমরা হয়তো আমাদের মাতৃভাষাতে সুখ পাইনা, কারণ আমাদের মন থেকে মাতৃভাষা প্রীতি উঠে গেছে। কিন্তু সুদুর চীন থেকে এসে সেই অপার সৌন্দর্য অবলোকন করে মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে যায় ফা হিয়েন।
ইবনে বতুতা বিশ্বের অন্য সব দেশ ফেলে রেখে বাংলা মুলুককেই বেছে নেয় স্বর্গ রাজ্য হিসেবে। হালের মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মাজেনাও সেই বাংলার সৌন্দর্যতে মুগ্ধ হয়ে এদেশেই থেকেছেন অনেক দিন। তার বাংলাদেশ প্রীতির কথা আমরা প্রায় সকলেই জানি।
তিনি কি পেয়েছিলেন এই দেশে, এই সবুজ জমিনে? যা আমাদের দেশে জন্ম নেওয়া অনেকেই দেখতে পাননা। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি ভ্যালেরি টেইলরের দিকে। দূর বিদেশীনী এই খ্যাতিমান চিকিৎসক বাংলাদেশকে ভালবেসে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন এই দেশে এই ভাষায় কথা বলে।
এখনো প্রতি বছর বিদেশ থেকে এ দেশে যারা ঘুরতে আসে তারা মুগ্ধ হয়। এ দেশেই আছে বিশ্বের সব থেকে বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত,বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন থেকে শুরু করে হৃদয়ের ভাজে ভাজে ভালবাসার স্পন্দন সৃষ্টিকারী অনেক কিছু।
শুধু দেখার মত চোখের অভাবেই বাঙ্গালীরা সেটা দেখতে পায়না। সেই সৌন্দর্যে অবিরাম তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধতা নিয়ে ফিরে যায় হাজারো ইবনে বতুতা। এদেশেরই কেউ ক্রিকেটে বিশ্ব সেরা হয়,সাহিত্যে জিতে আনে নোবেল পুরস্কার। অথচ পাশ্ববর্তী শতকোটি মানুষের দেশের ভাষার সাহিত্যিকেরা সে ভাষার সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হতে পারেনি। আমরা তবে কেন এই দেশ এই ভাষা নিয়ে গর্ব করবোনা।
আমরা তবে কেন এই ভাষাকে ভাল না বেসে এই দেশের সৌন্দর্যকে উপক্ষো করে কংক্রিটে মোড়া সৌন্দর্যের পিছনে ছুটে চলেছি অবিরাম? কবি তাই আক্ষেপ করে লিখেছেন “নিজ সুখ লুটে নিল দূর বিদেশীনি/দেখলিনা সেই সুখ খুঁজে কোন দিনই।
………………….
২১ জুলাই ২০১৫,দৈনিক ইত্তেফাক।