নিরার কথা মনে আছে?
যে নিরার একটি চিঠি এসেছিল ডাক যোগে। হলুদ খামে। খামের উপর খুব যত্ন করে কেউ একজন লিখেছিল নিরার নামটি। সে ভুল করে হোক আর ইচ্ছে করেই হোক নিরার নামটি দীর্ঘ ইকার যোগে লিখেছিল নীরা।
সেটাই ছিল নিরার জীবনের একমাত্র চিঠি। নিরা চলে যাবার আগে যে নোট রেখে গিয়েছিল সেই নোটে প্রথম চিঠির কথা উল্লেখ ছিল। ফুটফুটে সুন্দর ছিমছাম গড়নের নিরা সদাচারিয়ান ছিল। বিশাল বাউন্ডারী ঘেরা সবুজ চত্ত্বরে প্রথম যেদিন নিরার সাথে দেখা হয়েছিল সেদিন নিরা ছিল নির্বাক।কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই তার মূখে যেন কথার ফুলঝুরি ছুটতে শুরু করলো। আমি সদাচারিয়ান নই ফলে নিরার সব কথা আমার শোনা হতনা।
নিরাকে নিয়ে সবাই কথা বলতো। নভিসেস ড্রিলের সময় নিরার দাপুটে পারফরমেন্স যেমন সবার নজরে এসেছিল তেমনি গেমস গুলোতেও সে ছিল অগ্রবর্তী। নিরাকে আমরা ভালবাসতাম খুব,মনে মনে হিংসাও করতাম। নিরার সুন্দর দুটি চোখ ছিল বাদামী। চোখের দিকে তাকালে অদ্ভুত রকম মায়া হত। ওর চুলগুলো যদি সোনালী হতো তবে ওকে অনায়াসে বিদেশীনি বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। নিরাকে আমরা খুব হিংসেও করতাম ওর ঐ অদ্ভুত সুন্দর চোখ আর মিষ্টি হাসির জন্য। রুপন্তী বলতো নিরা না হাসা পযর্ন্ত নাকি বৃষ্টি আসেনা। কিন্তু সে হাসতো খুবই কম।
নাহ আমরা কখনোই নিরার কোন দুঃখ ছিল বলে জানতাম না।কিন্তু তার পরও নিরা চলে গেল। যাবার সময় সবার জন্য একটা নোট রেখে গেল। নোটের ভাজে সেই চিঠিটাও ছিল। হলুদ খামের চিঠি। যে খামের উপর খুব যত্ন করে দীর্ঘ ইকার যোগে নিরার নামটি লেখা ছিল।
শান্তি হাউজের থার্ড ডর্মে থাকতাম আমি। চত্ত্বরের সব থেকে সিনিয়র হওয়ায় বেশ কিছু সুবিধা ছিল আমাদের। তার পর ভাগ্য গুনে কিংবা প্রীতির মতে ভাগ্য দোষে আমি ছিলাম হাউজ প্রিফেক্ট। কাঁধে বিশাল দায়িত্ব নিয়ে সব সময় তটস্থ থাকতাম কিন্তু নিরার সাথে দেখা হলে মনটা শান্ত হয়ে যেত।
কি ছিল যেন ওর চোখে মুখে। আমার ফটো এলবামের প্রথম ছবিটা নিরার। হলুদ খামের চিঠিটা যখন এসেছিল আমরা তখন কলেজের শেষ কয়েকটা দিনের জন্য অপেক্ষা করছি। বাউন্ডারী ঘেরা এই চত্ত্বটির প্রতি মায়া জন্মে গেছে। প্রথম যেদিন এসেছিলাম কিংবা বলা চলে বাবা মা যেদিন সম্পুর্ন অপরিচিত এই ভূবনে আমাকে রেখে গিয়েছিল তখন আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। দেখতে দেখতে ছয়টি বছর কেটে গেল। এখন আবার কান্না পাচ্ছে। কলেজ ছেড়ে যাওয়ার কষ্টের সাথে নিরার হলুদ খামের চিঠিতে বয়ে নিয়ে আসা কষ্ট। পুর্বসুরীদের মত এ চত্ত্বর ছেড়ে চলে গেলেও প্রতিবছর একবার করে হলেও ফিরে আসা যাবে। কিন্তু নিরা? নাহ সে চলে গেছে বুকের মধ্যে চাপা কষ্ট নিয়ে। যে কষ্ট তার কাছে এসেছিল ডাক যোগে হলুদ খামে বন্দি হয়ে।
এক সপ্তাহ পর আমি যখন শেষ পরীক্ষার হলে বসবো আমার পিছনের সিটটা তখন ফাঁকা থাকবে।আমি জানি ফিরে তাকালেই দেখবো সেখানে নিরা নেই।বুকের মধ্যে ব্যথা হুহু করে ওঠে। নিরা কেন থাকবেনা? এর পর পরীক্ষার ফলাফল হবে। সাংবাদিক আসবে আমাদের খাকি পোষাকে ভি চিহ্ন দেখানো ছবি তুলতে। সামনের সারিতে এডজুটেন্ট আরও দু চারজন স্যার থাকবেন সেই সারিতে আমাদের সহপাঠিনীদের দুএকজনও থাকবে। শুধু যার থাকার কথা ছিল অাতিউতি করেও তাকে কোথাও পাওয়া যাবেনা। সে নিরা। ঐ ছবিতে খাকি পোষাকে দাড়িয়ে পোজ দেওয়ার ভাগ্য সম্ভবত তার ছিলনা। কদিন আগেই সে চলে গেছে।
উচ্চতর ডিগ্রি নিতে সুইডেন যাওয়ার স্বপ্ন ছিল নিরার কিন্তু সে সুইডেন না গিয়ে আরো দূরের দেশে গেল। সে দেশের টেলিফোনের কান্ট্রিকোড আমাদের কারো জানা ছিলনা।
কেমন আছে এখন সদাচারিয়ান নিরা?অন্য সদাচারিয়ানরা কি নিরাকে মনে রেখেছে? নিরা যে নোটটা রেখে গিয়েছিল তার শেষ দুটি লাইন কারো ভুলে যাবার কথা নয়। সে লিখেছিল “তুমি রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলে থাকা থালার মত বিশাল চাঁদ হতে পারো কিন্তু ঐ দূর দিগন্তে ক্ষীনভাবে জ্বলতে থাকা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে তোামর আফসোস হবেই”। কি বলতে চেয়েছিল নিরা?
আমরা যখন ইভিনিং প্রেপের জন্য তৈরি হচ্ছি নিরাও নিশ্চই তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু তার ডাক পড়লো এডজুটেন্টের রুমে। সেই প্রথম তার সাথে ডাক পড়লো আমাদেরও। ইভিনিং প্রেপ বাতিল করা হলো সেদিনের মত। ক্যাম্পাসে সম্ভবত জীবনে প্রথম এবং শেষবার ওটা ঘটেছিল। এডজুটেন্টের রুমে সারিবদ্ধ ভাবে দাড়ানো আমরা।আমাদের চোখের পলক পড়ছেনা।স্থির হয়ে আছে এডজুটেন্টের হাতে ধরে থাকা হলুদ খামের দিকে। সেই খামে কি আছে আমাদের জানা নেই। কোথাও কোন শব্দ নেই। আমরা সবাই যেন কারো জন্য শোক প্রকাশ করতে নিরবতা পালন করছি। সেই একজনকি নিরা ছিল?নিজের জন্য নিজেই যে দাড়িয়েছে শোক প্রকাশ করতে। হতেও পারে।
…………..চলমান।