আমরা এখন অতি আধুনিক হয়ে গেছি।সন্তানের হাত ধরে ঘুরতে যাওয়ার পরিবর্তে আমরা এখন বিদেশী ডগ নিয়ে ঘুরি কিংবা হাতে থাকে মোবাইল এবং অবিরাম স্যোশাল মিডিয়াতে ঘুরাঘুরিও চলতেই থাকে। আর সেই ফাঁকে আমাদের সন্তানেরা, আমাদের ছোটরা বঞ্চিত হয় আমাদের ভালবাসা থেকে,তৈরি হয় কৃত্রিম পরিবেশ। শহুরে জীবনে মা-বাবার পেশাগত ব্যস্ততার কারণে এবং বিকল্প বিনোদনের তেমন ব্যবস্থা না থাকায় এ যুগের বাচ্চাদের বেবী সিটার বলা যায় কার্টুনকে। কত রকম কার্টুন যে তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে তার কোন সীমা নেই।
কিন্তু কার্টুন গুলো আমাদের বাচ্চাদের আনন্দ দিলেও কি শেখাচ্ছে সেটা কি কখনো আমরা ভেবে দেখেছি?কার্টুন দেখে দেখে আমাদের বাচ্চাদের মেধা ও মননে বিরুপ প্রতিকৃয়া তৈরি হচ্ছে তা কি কখনো ভেবে দেখেছি?পাচ বছরের একটি ছেলে যখন কার্টুন দেখে বাবা মায়ের কাছে আবদার করে সুপার ম্যানের পোষাক কিনে দিতে এবং না দিলে কেদে আকাশ মাটি এক করে ফেলে তখন বাবা মা বাধ্য হয়ে ছেলেটিকে সেই পোষাক কিনে দেয় এবং সেখানেই যদি সব থেমে যেত তাহলেও কথা হত।সেই পোষাক পরে বাচ্চা ছেলেটি যখন উচু থেকে লাফিয়ে পড়ে হাত পা ভেঙে ফেলার মত ঘটনা ঘটায় এবং বলে সুপার ম্যান যে পোষাক পরে লাফ দিলে কিছু হয়না আমি সে পোষাক পরে লাফ দিলে ব্যথা পাই কেন তখন বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হয়। কার্টুনের ভালো-মন্দ বিতর্ক খুব নতুন কিছু নয়। সারা বিশ্বে এ নিয়ে বহু বিতর্ক প্রচলিত। বাংলাদেশে এখনো সচেতনতার বড় অভাব। তাই লেখার প্রয়োজনবোধ করছি।
কার্টুন আমাদের শিশুদের মনে নানারকম প্রতিকৃয়া সৃষ্টি করছে।আমরা জানি ভাল কিছুর চেয়ে খারাপ দিকেই মানুষের ঝোক বেশি।তাই কার্টুন যেহেতু বাচ্চাদের মনস্তাত্তিক বিষয়টাকে মাথা রেখে তৈরি হয় তাই সেটা বাচ্চাদের মোহগ্রস্থ করে রাখবে সেটাই স্বাভাকি।ফলে সেই অগচরে বাচ্চারা এমন সব বিষয় শিখছে যেখানে মোরালিটিতে আঘাত লাগছে। সাত বছরের একটা মেয়েকে রেখে তার মা যখন না ফেরার দেশে চলে গেল তখন সেই মেয়েটিকে মানুষ করার জন্য একজন মায়ের অভাব দেখা দিল।ওর একাকীত্ত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ওকে মানুষ করার জন্য যখন ওর বাবা আরেকটা বিয়ে করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এবং বলছেন আমাদের রাজকন্যার জন্য নতুন একটা মা নিয়ে আসি তখনি ছোট্ট মেয়েটি বিরুপ প্রতিকৃয়া দেখাচ্ছে।
সে কোন ভাবেই নতুন মা চায় না।কেন চায়না? তারও যুক্তি সে এই বয়সেই দাড় করিয়ে ফেলেছে।কার্টুনই তাকে সেটা শিখিয়েছে যা আদতে শিক্ষার নামে অপশিক্ষাই বলতে হচ্ছে। সে বলছে স্টেপ মাদার খারাপ হয়! অথচ ওই বয়সী একটা বাচ্চার সৎ মা বা স্পেট মাদার কি তা বুঝার কথাই নয়।এমন নয় বাসার কেউ বিষয়টা তাকে শিখিয়েছে। সে কার্টুন দেখে এটা শিখেছে। সে বলছে স্লিপিং বিউটির স্টেপ মাদার খারাপ ছিল,স্নো হোয়াইটের স্টেপ মাদার খারাপ ছিল,সিন্ডেরেলার স্টেপ মাদার সিন্ডেরেলাকে কষ্ট দিয়েছিল তাই সব স্টেপ মাদারই পচা হয়,খারাপ হয়।
আমারও যদি স্টেপ মাদার আসে তবে সেও খারাপ হবে,আমাকে কষ্ট দেবে।এমনকি এটুকু বলেই কিন্তু বাচ্চাটা থেমে থাকেনি। সে মনে করে সুযোগ পেলে স্টেপ মাদার তাকে মেরেও ফেলতে পারে যেমন সিন্ডেরেলার মা তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।দেখা যাচ্ছে অনেক বাচ্চাই কার্টুন না দেখালে খেতে চায় না।যতক্ষণ কার্টুন চলে ততোক্ষণ সে খাবার খায় যা সত্যিকার অর্থেই একটা বিরক্তিকর ব্যাপার।স্কুলে গিয়ে কোন একটা বাচ্চা দুষ্টুমী করছে,বাচ্চারা দুষ্টুমী করতেই পারে কিন্তু সেটা যদি সীমার বাইরে চলে যায় এবং পরিবারকে জানানোর পর যখন কার্টুন দেখা বন্ধ করে দেওয়া হয় দেখা যায় বাচ্চা বাসার এটা ওটা ভাংতে শুরু করেছে।এ গুলো অবশ্যই কার্টুনের নেতিবাচক প্রভাব। অবশেষে আমরা বাধ্য হয়ে হার মানি এবং আবার তাকে কার্টুন দেখতে দেই। এখন কার্টুন দেখে কোমলমতি শিশুরা লিপকিস কি জিনিষ সেটাও শিখে ফেলছে অবলিলাক্রমে যা কোন ভাবেই গ্রহনযোগ্য কোন বিষয় হতে পারেনা। কিছু কিছু বাচ্চা তার ক্লাসেই এটা নিয়ে আলোচনা করছে এবং বলছে লিপ কিস হলো ট্রু লাভ কিস। এটা করলে প্রিন্সেস গিসেলের মত একে অন্যকে ভালবাসবে!
অগণিত কার্টুনের মধ্যে হাতে গোনা যে একটা দুটো কার্টুন আমাদের শিশুদের শিক্ষা দেয় সেই সব কার্টুন হয় আমরাই বাচ্চাদেরকে দেখতে অভ্যস্থ করিনা কিংবা তারাই দেখতে চায়না।সিসিমপুর যখন একটা বাচ্চাকে নানা কৌশলে নানা কিছু শেখাতে ব্যস্ত সেখানে মটুপাতলু তার উল্টোটা।টম এন্ড জেরি,মিকি মাউস আরো কত কত যে কার্টুন আছে বলে শেষ করা যাবেনা। আর ডোরেমনতো রীতিমত আমাদের বাচ্চাদেরকে ফাঁকিবাজি শেখাচ্ছে। এসব কার্টুন বন্ধ হওয়া উচিত। বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিয়ে দেখুন ডোরেমনের নির্মাতা দেশেই ডোরেমন দেখেনা ৯০ ভাগেরও বেশি শিশু আর আমাদের দেশে তা দেখে ৯৫ ভাগেরও বেশি শিশু।টিভি,কম্পিউটার বা সিডি না থাকলে শিশুরা পরিবারের কারো না কারো মোবাইলেই দেখে কার্টুন।আর সেই সব কার্টুনের যোগান দাতা হই আমরা নিজেরাই। এভাবেই জেনে শুনে আমরা আমাদের শিশুদের অশিক্ষা অপশিক্ষার পথে ধাবিত করি।
একটা শিশু বর্ণ মালা চেনেনা কিন্তু একে ফর্টিসেভেন,থ্রি নট থ্রি রাইফেল চেনে কার্টুন দেখে।শিশু মনে যা পায় তা স্থায়ী ভাবে দখল করে নেয়।তাই নেতিবাচক বিষয় যদি শিশু মনে একবার ঢুকে যায় তা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন।বিনোদনের জন্য যদি কার্টুন ফরজ কিছু হয়ে থাকে তবে এদেশে কি নির্মাতার অভাব?কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে যে সব আজগুবী বানিজ্যিক সিনেমা বানানো হচ্ছে তার পরিবর্তে শিক্ষামুলক কার্টুন কি তৈরি করা যায়না?দুই বার অস্কার বিজয়ী নাফিস বিন জাফরও কিন্তু বাংলাদেশের সন্তান এবং বিখ্যাত এনিমেটর।সুতরাং সদিচ্ছার অভাবেই মুলত তা হয় না।সর্বস্তরের মানুষের উচিত কার্টুনের ক্ষতির দিকটা বিবেচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। না হলে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের শিশুরা কিভাব বেড়ে উঠবে সেটা কল্পনারও বাইরে গিয়ে দাড়াবে।এবং তখন হয়তো আমাদের আর করার কিছু থাকবে না।
১১ জুলাই ২০১৬