গত কালকের সড়ক দূর্ঘটনার ঘটনা জানি না কত জনের চোখে পড়েছে। আমি ঘটনাটি জেনে মর্মাহত হয়েছি। এই দূর্ঘটনা ঘটেছে ফরিদপুরে। ইউনিক পরিবহনের একটি বাস ঢাকা থেকে মাগুরার দিকে আসছিলো আর ফরিদপুর থেকে একটি পিকাপ ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৪ জন মারা গেছে। যার মধ্যে একই পরিবারের ৫ জন সদস্য ছিলো। এই পাঁচজন সদস্যের একমাত্র উপার্জনকারী মানুষটি ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে লিফটম্যান হিসেবে চাকরি করতেন। স্বল্প আয়ের মানুষ। ঈদ শেষে পরিবার সহ পিকাপে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। সাথে ছিলো তার স্ত্রী,পুত্র,কন্যা এবং মা। ৫জন মানুষ নিয়ে বাসে যাওয়ার মত আর্থিক সংগতি তার ছিলো না বলেই তাকে বাধ্য হয়ে পিকাপে উঠতে হয়েছিল। নিম্ন আয়ের মানুষদের আসলে এ ছাড়া করার কিছু থাকেও না। কিন্তু সে কি আর জানতো আর কোনো দিন লিফটম্যান হিসেবে কাজ করা হবে না। আর কখনো ঢাকায় ফেরা হবে না। কোটি কোটি বছর পৃথিবী থাকবে। প্রতি বছর ঈদ আসবে। অনেকেই প্রিয়জনের টানে গ্রামে ছুটে যাবে। আনন্দের সাথে ঈদ করবে। আবার ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফিরে যাবে। কিন্তু তার কখনো যাওয়া হবে না। তাকে যে পরিবার সহ পৃথিবী থেকেই ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই দূর্ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী কে? ওই বাস বা ওই পিকাপ যে কোনোটিই হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করি তাহলে বাসকেই দায়ী করতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী ২০ বছরের পুরোনো কোনো বাস রাস্তায় চলাচল করতে পারবে না। আর ২৫ বছরের পুরো কোনো ট্রাক বা লরি রাস্তায় চলাচল করতে পারবে না। এই যে ইউনিক পরিবহনের যে বাসটি মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হলো সেই বাসটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে অনেক আগেই। ২০০২ সালে নিবন্ধিত বাসটি ২০২২ সালেই বিশ বছর পূর্ণ করেছে। তারপরও বহালতবিয়তে সেটা বুক উচু করে চলছে। সরকার কোনো ভাবেই বাস মালিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
শকিং নিউজ হলো দূর্ঘটনা কবলিত ইউনিক পরিবহনের এই বাসটিই যে মেয়াদোত্তীর্ণ তা কিন্তু নয় বরং বিআরটিএর তথ্য মতে ঢাকায় চলাচলকারী এবং ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ২০ বছরের বেশী বয়সী অর্থাৎ মেয়াদোত্তীর্ণ বাস সংখ্যা ৩৫ হাজার ৭৮২ টি। এবং ট্রাক ও লরি সংখ্যা ৩৭ হাজার ২৭৫ টি যা ২৫ বছরের বেশী বয়সী। আমার ধারণা এই সংখ্যা আরও বেশি। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো উত্তরা ইউনিক পরিবহনের ওই বাস সহ দেশে ৬ লাখ নিবন্ধিত গাড়ি বাৎসরিক যে ফিটনেস টেস্ট করা বাধ্যতামূলক তা করে না। ফলশ্রুতিতে খোদ বিআরটিএর তথ্যই বলছে প্রতি বছর আগের বছরের তুলনায় দূর্ঘটনার হার বেড়েই চলেছে। বছর শুরু হতে পারেনি এর মাঝে হতাহতের যে ঘটনা ঘটেছে তা আশেপাশে অনেক দেশের বিশ বছরের সংখ্যার চেয়েও বেশি। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের শেষ দিন পযর্ন্ত দেশে ১৪৭৭ জন মানুষ সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছে, ১৯২০ জন হতাহত হয়েছে। আর এই সংখ্যক হতাহত ও মৃত্যুর ঘটনার পিছনে ১৬৩০ টি দূর্ঘটনা দায়ী।
আমরা যদি আগের বছরের দিকে ফিরে তাকাই তবে দেখতে পাই ২০২৩ সালে ঠিক একই সময়ে অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে মোট ১ হাজার ১৭টি দূর্ঘটনা ঘটেছিল। যার মাধ্যমে ১ হাজার ৫১ জন মৃত্যুবরণ করেছিল এবং ১৪৪০ জন আহত হয়েছিল।
মূলত গাড়ি যত পুরোনো হয় তা দেখভাল করতে ততো বেশি খরচ হয়। ফলে দেখা যায় গাড়ির মালিকেরা পুরোনো গাড়ির প্রতি সেভাবে নজর দেয় না। কারণ পুরোনো গাড়ি ঠিকঠাক মেইনটেন করতে গেলে মালিকের খরচ বাড়ে। আয়ের সাথে ব্যায়ের পার্থক্য বেড়ে গিয়ে তার লাভের পরিমান কমে যায়। এই কারণে তারা এটিকে এড়িয়ে চলে। ব্যক্তিগত সার্থের বলি হয় তখন সাধারণ মানুষ। দূর্ঘটনায় জীবন চলে যায়। সরকার কিছুই করতে পারছে না কারণ পরিবহন এসোসিয়েশন থেকে তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। সরকার যদি কারো মুখাপেক্ষি না হতো, নিজের অবস্থানে অটুট থাকতে পারতো তাহলে পরিবাহন মালিক সমিতির যে কোনো চাপ তারা উপেক্ষা করে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারতো। আর সেটা করতে পারলে সড়ক দূর্ঘটনার পরিমান কমিয়ে প্রায় শুণ্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হতো। এমনকি সরকারের এ বিষয়ে কোনো রোড ম্যাপ আছে বলেও আমার মনে হয় না। এই যে হাজার হাজার মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি রিপ্লেস করে নতুন গাড়ি নামানো দরকার এ নিয়ে তারা কখনো দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।
যখন সরকারদলীয় কোনো নেতা বা আমলা বা সংশ্লিষ্ট কেউ সরকারের কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করে তখন সেই কাজটি করে ওঠা খুবই কঠিন। পরিবাহন খাত কারা নিয়ন্ত্রণ করে সেটা দেখলেই বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়ে যাবে। এই যে প্রতিনিয়ত দূর্ঘটনায় অগণিত প্রাণ যাচ্ছে তার দায়ভার সরকার এড়িয়ে যেতে পারে না। মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি এবং প্রশিক্ষিত চালকের অভাব যেমন আছে তেমনি নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় গাড়িগুলো বহালতবিয়তে চলাফেরা করছে।মানুষ মরছে এই সব দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করার জন্য। আমার বেশ মনে আছে সর্বশেষ ২০১০ সালে বিআরটিএ ২০ বছর বা তার চেয়ে পুরোনো বাস এবং ২৫ বছর বা তার চেয়ে পুরোনো ট্রাক ও লরি ব্যান করেছিল। গত ৩১ মার্চ মন্ত্রীপর্যায়ের মিটিংয়ে যখন বিআরটিএর কাছে পুরোনো গাড়ির তথ্য চাওয়া হয়েছিল তখন তারা যে তথ্য দিয়েছিল তা থেকে আমরা দেখতে পাই মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা ৭৩ হাজার ৫৭ টি! শুধু তাই নয় তাদের তথ্য বলছে প্রায় ৪ লাখ ৭৯ হাজার গাড়ি ২০১৯ সালের পর আর কোনো ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন করেনি! এখানেই যদি শেষ হতো তাও কথা ছিলো। কিন্তু ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এই সংখ্যাটি ৫ লাখ ৮ হাজারে গিয়ে ঠেকেছিল এবং গত সোমবার পযর্ন্ত যার সংখ্যা ৬ লাখ ১৭ হাজার!
আর কত প্রাণ সড়কে লেপটে গেলে আমাদের হুশ ফিরবে? আমরা কার সার্থ রক্ষা করে চলেছি এই সব মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়িকে বহালতবিয়তে রাস্তায় চলতে দিয়ে?
-জাজাফী
১৭ এপ্রিল ২০২৪