বইয়ের মত অকৃত্রিম বন্ধু আর হয় না। বই পড়ায় যে আনন্দ তার একটি ধারণা পাওয়া যায় বিশ্ববিখ্যাত শিশুতোষ লেখক রোয়াল্ড ডালের লেখা “মাতিলদা” বই থেকে। যেখানে মাতিলদা নামের ছোট্ট মেয়েটি বই পড়ায় এতো বেশি আগ্রহী যে পড়তে শেখার পর পরই সে লাইব্রেরীতে গিয়ে অসংখ্য বই পড়ে ফেলে। হলিউডে এটা নিয়ে দুটো সিনেমাও হয়েছে। বই পড়ে আমরা হাসি,কাদি,আনন্দপাই আবার অনেক জ্ঞানার্জনও করি। তবে অনেকেই বই পড়তে খুব একটা পছন্দ করে না। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা বইপড়তে খুবই ভালোবাসে। আর আমরা তাদের বলি বইয়ের পোকা। ছোটবেলা থেকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে জীবনে নানা সুবিধা পাওয়া যায়। কখনো নিজেকে একা লাগে না। মনে হয় সবচেয়ে সেরা বন্ধুতো আমার সাথেই আছে। আর সেই সেরা বন্ধু হলো বই। বই আমাদের নতুন এক জগতের সন্ধান দেয়। আমরা যত বেশি বই পড়ি আমাদের মনের চোখ খুলে যায়। আমরা কল্পনা করতে পারি নতুন নতুন ভূবনের। আমাদের চিন্তার প্রসার ঘটে। জ্ঞানের বিকাশ ঘটে।
কর্মব্যস্ত জীবনে অনেকেই বই পড়ার সুযোগ মেলে না বলে অভিযোগ করে। আবার উল্টোটাও দেখা মেলে। বিশ্ববিখ্যাত মানুষ বিলগেটস বা মার্ক জুকারবার্গও প্রচুর ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু তাদের বই পড়ার যে নিয়মিত অভ্যাস তাতে কোনো অসুবিধা হয় না। তারা সময় বের করে প্রতিদিনই বই পড়েন। একজন মানুষ তার সারা জীবনে ঠিক কতগুলো বই পড়তে পারে? কেউ কেউ বলেন ৫ হাজার আবার কেউ কেউ বলেন ১০ হাজার। বইয়ের সাইজ,ধরণ এসবের উপর সব কিছু নির্ভর করে। কেউ যদি রাত দিন পড়তেই থাকে তবে সে হয়তো অনেকগুলো বই পড়তে পারবে। আর যারা সবে মাত্র কিন্ডারগার্টেন শুরু করেছে এবং যাদের বয়স ১২ বছর বা তার কম তাদের পক্ষে ওই বয়সে ঠিক কতগুলো বই পড়া সম্ভব? স্কুলের পড়া,খেলাধুলা,টিভি দেখা সব কিছু বাদ দিয়ে যে সময় মেলে তাতে হয়তো ১০ থেকে ২০ টা বই পড়তে পারে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো পৃথিবীতে এমন অনেক শিশু কিশোর কিশোরী আছে যারা কিন্ডারগার্টেন পার হওয়ার আগেই ৩০০ থেকে ১০০০ বই পড়ে ফেলেছে! অনেকের কাছেই এই তথ্যটি অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তারা চাইলে ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই এর সত্যতা খুঁজে পাবে। তেমনই কিছু শিশু কিশোর কিশোরীর গল্প শোনাতে চাই।
লানা রেনল্ড ও জুদাহ রেনল্ড
আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার অন্তর্গত ব্রুকভিল নামক স্থানে একটি লাইব্রেরি আছে যার নাম রেবেকা এম আর্থার্স লাইব্রেরী। স্থানীয় মানুষ এই লাইব্রেরীর সদস্য। সদস্যদের মধ্যে রয়েছে শত শত শিশু কিশোর কিশোরী। সেই সব শিশু কিশোর কিশোরীদের অনেকেই এক হাজার বই পড়ে ফেলেছে আবার কারো কারো সংখ্যা এক হাজারের কাছাকাছি চলে গেছে। তারা এই লাইব্রেরীতে এসেই পড়ছে এবং তারা পড়াটাকে খুব উপভোগ করছে। তাদেরই একজন লানা রেইনল্ড। সে কিছুদিন আগেই এক হাজার বই পড়ে শেষ করেছে। লানা যখন খুব ছোট ছিলো তখন সে দেখতো মা তার পাশে বসে বই পড়ছে। কখনো কখনো মা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বই পড়তেন। সেই থেকে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয় লানার মনের মধ্যে। সে হয়তো তখনই মনে মনে ভেবে রেখেছিল মায়ের মতই সেও অনেক বই পড়বে। রোজ রাতে ঘুমানোর আগেও মা তাকে বই থেকে গল্প শোনাতো। সেই সব গল্পে রাজপুত্র,রাজকন্যা যেমন থাকতো তেমনি অনেক সুন্দর সুন্দর শিক্ষনীয় ঘটনাও থাকতো। তারপর সে যখন স্কুলে গিয়ে দেখে দেখে পড়া শিখলো তখন সে মায়ের পাশে বসে তার উপযোগী বই পড়তো।
লানা যতগুলো বই পড়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় বই “দ্য নেস্টিং বার্ড”। কারণ সে পাখির ছানা খুব ভালোবাসতো। লানার ছোট্ট একটা ভাই আছে। মা যেমন ছোট বেলায় তাকে গল্প পড়ে শোনাতো লানা নিজেও পড়তে শেখার পর তার ছোট ভাই জুদাহ রেনল্ডকে পাশে বসিয়ে বই পড়ে শোনাতো। এভাবে তার ভাইও বইয়ের প্রতি ভালোবাসায় আটকা পড়লো। ছোটবেলা থেকে লানা যে সব বই পড়েছিল সেগুলোই এখন জুদাহ নিজে পড়ছে। আর সে এরই মধ্যে ২০০ বই পড়ে ফেলেছে। বয়স যদিও মাত্র ৭ বছর! আর তার প্রিয় বই “পিটি দ্য ক্যাট”।
লানার বই পড়ার শুরুটা তার মায়ের হাতে হলেও সেটা গতি পেয়েছিল রেবেকা এম আর্থার্স লাইব্রেরীর বই পড়া কর্মসূচীর মাধ্যমে। বাংলাদেশে যেমন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ার কর্মসূচী আছে অনেকটা সেরকম। লানার মায়ের নাম মাইলিয়া রেনল্ড তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে বইপড়া কর্মসূচীর বিষয়ে জানতে পেরেছিলেন। সেই বান্ধবী তার বেবীদেরকে খুব ছোট বেলা থেকেই ওই লাইব্রেরীতে নিয়ে যেতেন এবং নিজেও বই পড়তেন। এটা শুনে মাইলিয়ার মনে হলো তিনি লানাকেও ওই লাইব্রেরীর সদস্য করবেন। বাড়িতে বসে অনেক বই পড়া হয়েছে। আরও কত শত বই আছে যার সব কিনে পড়া যেমন সম্ভব নয় তেমনি অনেক বইয়ের সন্ধানও অনেক সময় পাওয়া হয়না। কিন্তু লাইব্রেরীতে গেলে যেমন অসংখ্য বই পাওয়া যাবে তেমনি পড়ার পরিবেশও ভালো থাকায় পড়ায় গতি আসবে। তাছাড়া মাইলিয়া মনে করতেন এই পড়ার অভ্যাস তার ছোট্ট ছেলে মেয়েকে ভবিষ্যতে সফল হতে সহযোগিতা করবে। সেই থেকে লানা আর তার ভাই জুদাহ বাড়িতে পড়ার পাশাপাশি লাইব্রেরীতে গিয়েও পড়তে শুরু করলো। উল্লেখ্য লানা ও তার ভাই মূলত হোমস্কুল করতো বলে তাদের হাতে ছিলো পড়ার মত অনেক বেশি সময় ও সুযোগ।
বেথেনি ফ্রিটজ
লানা রেনল্ডের মতই বেথেনি ফ্রিটজ নামের মেয়েটিও বইয়ের পোকা। সেও এরই মধ্যে ১ হাজার বই পড়ে শেষ করেছে। বেথেনির দাদি আন ফ্রিটজ বলেছেন বেথেনির বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন থেকে সে লাইব্রেরীর গ্রীষ্মকালীন বইপড়া কর্মসূচীতে নাম দিয়েছিলো। বেথেনিদের বাসায় যে রেফ্রিজারেটর আছে সেটার দরজায় সে একটা চার্ট লাগিয়ে রেখেছিল কবে কখন কোন বই পড়বে। রোজ সে সকালে এবং রাতে ঘুমানোর আগে নিয়ম করে বই পড়তে শুরু করেছিল। বেথেনিও লাইব্রেরী খুব ভালোবাসতো। বইয়ের রাজ্যে সে আনন্দের সাথে বিচরণ করতো। লাইব্রেরী থেকে যখনই যে অফার দিতো সে ও তার পরিবার তা লুফে নিতো। জুদাহের মত বেথেনির প্রিয় বইয়ের নামও “পিটি দ্য ক্যাট”। বেথেনি বলেছে এই বইটি তার বেশি ভালো লেগেছে কারণ যে বিড়ালটিকে নিয়ে এই বইটি লেখা হয়েছে সে খুব মজার মজার ঘটনা ঘটায়। সেগুলো পড়লে খুব আনন্দ হয়, হাসি পায়।
লাইব্রেরীতে বসে পড়ার পাশাপাশি লাইব্রেরী থেকে পছন্দের বই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ারও সুযোগ আছে। একবার তাকে যখন প্রশ্ন করা হলো কোন বইটি তুমি বাড়িতে নিয়ে পড়তে চাও? সে বলেছিল পারলে সবগুলোই সে বাড়ি নিয়ে পড়তে চায়! বইগুলো কিন্তু খুব বেশি বড় না। ছবিযুক্ত দারুণ সব ফিচার বুক। যেখানে ছবির সাথে সাথে কয়েক লাইন করে গল্পবলা হয়। ফলে খুব দ্রুতই পড়া হয়। বেথেনি ঘুম থেকে উঠে বই পড়ে, নাস্তার টেবিলে নাস্তা করতে করতে বই পড়ে। নাস্তা শেষ হলে বই পড়ে। দুপুরে ঘুমোতে যাবার আগে বই পড়ে আবার ঘুম থেকে উঠেও বই পড়ে। রাতে খাবারের আগে বই পড়ে আবার খাবার শেষেও বই পড়ে। আর ঘুমোতে যাবার আগেও বই পড়ে! বই বই আর বই। মুনির হাসানের একটা বইয়ের কথা মনে পড়লো। যে বইটির নামই “ পড়ো পড়ো পড়ো”। বেথেনি বা লানারা যদিও মুনির হাসানের বইটির কথা জানে না কিন্তু তারা যেন পণ করেছে শুধু পড়বে আর পড়বে।
অ্যাবি হলিস:
আরেক পড়ুয়ার নাম অ্যাবি হলিস। বয়স এখন মাত্র ৬ বছর। এ বছর সে কিন্ডারগার্টেন পার করবে। এরই মধ্যে সে রেবেকা এম আর্থার্স লাইব্রেরীর গ্রীষ্মকালীন বই পড়া কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে ৯০০ বই পড়ে ফেলেছে। অ্যাবি খরগশের গল্প পড়তে বেশি ভালোবাসে। তার ইচ্ছে ১০০০ বই পড়া শেষ করে সে লাইব্রেরী থেকে পুরস্কার নিবে। এই প্রোগ্রামে যারাই ১০০০ বই পড়া শেষ করেছে তাদেরকে লাইব্রেরী থেকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। এই এক হাজার বই পড়ার জন্য সময় পাওয়া যায় পুরো এক বছর। অনেকে ভাবতে পারে এই বয়সে এক বছরে ১ হাজার বই পড়া কিভাবে সম্ভব? তাদের জন্য একটি তথ্য যুক্ত করেছেন রেবেকা এম আর্থার্স লাইব্রেরীর লাইব্রেরিয়ান। বাচ্চাদের বই পড়ায় উৎসাহ যোগাতে তারা একটি ব্যতিক্রম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বাচ্চাদের বইগুলো সাধারণত খুব ছোট হয়। ২০ থেকে ৩০ পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ হয়। ছবি আর লেখায় বইটি পরিপূর্ণ থাকে। ফলে দেখা যায় একটি বইয়ের শব্দ সংখ্যা ৫০০ থেকে ১০০০ এর কম হয়। ফলে এক বসাতেই পুরো বই পড়া হয়ে যায়। অন্যদিকে কোনো বাচ্চার যদি কোনো বই খুব ভালো লাগে এবং সে যদি সেই বইটি বারবার পড়ে তবে প্রতিবার পড়া হিসেবে একটি সংখ্যা কাউন্ট করা হয়। মানে অ্যাবি হলিস তার পছন্দের বইটি যদি ১০০ বার পড়ে থাকে তবে সে একশোটি বই পড়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। লাইব্রেরিয়াম স্ট্রম মনে করেন রিপিটেশনের মাধ্যমে বাচ্চারা যেন বইয়ের বিষয়বস্তু আরও ভালোভাবে জানতে ও শিখতে পারে তাই এই ব্যবস্থা রাখা।
বই আমাদের মনের চোখ বাড়ায়। আমাদের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করে। বই পড়ে আমরা যেমন আনন্দ পাই তেমনি শিখতে পারি অনেক কিছু। আমাদের জাতীয় গ্রন্থাগারের গেটের বাইরে এক সময় বড় একটি পাথরের বই তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে বড় করে লেখা ছিলো “ পড়িলে বই আলোকিত হই, না পড়িলে বই অন্ধকারে রই”। আর এ কারণেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তাদের কর্মসূচীর নাম দিয়েছিল ”আলোকিত মানুষ চাই”।
৮ জানুয়ারি ২০২৪