রোজই কারো না করো বাড়িতে চুরি করতো লোকটি।বলতে গেলে কোন দিন খালি হাতে তাকে ফিরতে হত না।চুরি করা দ্রব্যাদি সে চোরাই মার্কেটে বিক্রি করে যা পেতো তা দিয়েই সংসার চলতো।একদিন সে দেখলো আশে পাশে আর কারো বাড়িতে চুরি করতে তার বাকি নেই।ভাবলো পরবর্তী মহল্লায় সে চুরি করবে।কিন্তু সত্যি বলতে চুরি করতেও তার ভাল লাগতো না।সে একটা কাজ চাইতো কিন্তু কে তাকে কাজ দেবে?তাই একদিন দুদিন করে করে তার হাতটানের স্বভাব হয়ে গেল।তবে মনে মনে তার খুবই ইচ্ছে হত একদিন নিশ্চই সে চুরি ছেড়ে দেবে এবং সত্যিকার কোন কাজ করবে।
নতুন মহল্লায় চুরি করতে গিয়ে প্রথমে যে বাড়িতে ঢুকলো দেখলো লোকগুলো মধ্য রাতেও জেগে আছে।সে যখন ফিরে আসবে ঠিক তখন শুনতে পেলে কোন একজন মুরুব্বি লোক কথা বলছে।দরজার পাশে দাড়িয়ে সে কান পাতলো আর তখন শুনতে পেলো লোকটি সবাইকে গল্প শোনাচ্ছে।চোর হলেও তার গল্প খুব ভাল লাগে।চুরির গল্প চোরাই মালের আড়তে গিয়ে কতভাবে যে ইনিয়ে বানিয়ে সে বলে তা মনে করে নিজেরই অবাক লাগে।কিন্তু সেসবতো মিথ্যে গল্প।আজ যখন সত্যিকার কোন গল্পের আসরের খুব কাছে সে চলে এসেছে তখন একটা গল্প শুনতে অসুবিধা কোথায়।
বুড়ো লোকটা বললেন মনে করো একজন মানুষকে তুমি একটা বড় মাছ কিনে দিলে তখন সে সেটা বাড়ি নিয়ে খুব যত্ন করে রান্না করে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে তার পর সব শেষ। আর তুমি যদি তাকে মাছ ধরা শিখিয়ে দাও তাহলে সারা জীবন সে মাছ ধরে খেতে পারবে।এই গল্পটা তার খুবই ভাল লাগলো। সে যখন উঠে চলে আসতে যাবে ঠিক তখন সে শুনতে পেলো গল্প কথক বৃদ্ধ লোকটির নাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।তিনি যেই হোন না কেন তাকেঁ সে চেনেনা তবে তাঁর বলা গল্পটি খুবই মনে ধরে গেল।এখনো বেশ খানিকটা রাত বাকি আছে খালি হাতে ফিরে যাওয়া ঠিক হবেনা ভেবে যে বাড়িতে বসে গল্প শুনছিল ওই বাড়িরই একটা বিশাল রুমে ঢুকে পড়লো।
সবাই যেহেতু গল্প শোনায় ব্যস্ত তাই তার চুরি করতে কোন বাধা নেই।সে টর্চের আলো ফেলে কি কি নেওয়া যায় সেটা পরখ করে দেখার জন্য রুমের চারদিকে তাকিয়ে দেখলো সারা ঘর ফাঁকা! দেয়ালের দিকে টর্চ ফেলতে তার চোখের পলক যেন আর পড়তেই চায়না।প্রতিটি দেয়ালে সুন্দর করে সাজানো আছে বাঁধাই করা সব ছবি।এতো সুন্দর ছবি সে জীবনে কোন দিন দেখেনি।সেই সব অসাধারণ ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হলো চুরি না করে সেও যদি এমন ছবি আঁকতে পারতো।
একবার ভাবলো দেয়াল থেকে সবচেয়ে সুন্দর দেখে কিছু ছবি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করলে অনেক টাকা হবে তখন একমাস দুইমাস চুরি না করলেও চলবে।ঠিক সেই সময় মনে পড়ে গেল আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নামের সেই লোকটির বলা গল্পটি।মাছ কিনে দেওয়ার চেয়ে মাছ ধরা শিখিয়ে দিলে সারা জীবন ধরে খেতে পারবে।ঠিক তেমনি ভাবে সুন্দর সুন্দর ছবি এখান থেকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকা শিখতে পারলে সারা জীবন আঁকা যাবে।
চোর এবার রুমের এক কোনায় গেল।সেখান থেকে খুব যত্ন করে রেখে দেওয়া রঙ আর বিভিন্ন মাপের তুলি নিজের ঝুলিতে নিয়ে একটা পেইন্টিং স্ট্যান্ডও নিয়ে নিল। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে ছবিগুলো দেখে নিল। তার পর মনে মনে ভাবলো আমিও ওরকম ছবি আঁকবো।
পরদিন সকালে তিশিয়ান বাবার হাত ধরে বাবার পেইন্টিং রুমে আসলো ছবি আঁকার কলাকৌশল শিখবে বলে।বাবা মেয়েকে যত্ন করে ছবি আঁকা শেখাবেন বলে এসে যখন বসলেন তখন ভীষণ ভাবে চমকে গেলেন।তার ছবি আকার তুলি এবং রং একটাও নেই!দুজন মিলে অনেক খুঁজেও আর পাওয়া গেলনা।তিনি অবাক হয়ে দেখলেন চারদিকের দেয়ালে দেয়ালে লাখ টাকা মূল্যের অনেক চিত্রকর্ম অক্ষত আছে শুধু নেই রং তুলি।চোরে চুরি করলেতো পেইন্টিংস গুলিই নেওয়ার কথা!
বিকেলে মার্কেট থেকে বাসায় ফেরার পথে দৃক গ্যালারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিশিয়ান আর তার বাবা গ্যালারিতে ঢু মারলেন।দেখলেন সেখানে নতুন একটি অসাধারণ চিত্রকর্ম।গ্যালারির পরিচালক টিটু সাহেবের পরিচিত।তিনি জানতে চাইলেন এই অসাধারণ চিত্রকর্মটি কার এবং কোথায় পেলেন? পরিচালক জানালেন আজ বিকেলে একজন এটা বিক্রি করে গেছে,আজই সে এটা এঁকেছে এবং এটাই নাকি তার জীবনের প্রথম আঁকা ছবি! তিশিয়ান আর তার চিত্রশিল্পী বাবা খুবই অবাক হলেন।দশ বছর ধরে সাধনা করেওতো কেউ এতো সুন্দর ছবি আঁকতে পারেনা।
পরদিন ছুটির দিন থাকায় তিশিয়ান তার বাবাকে নিয়ে ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে চলে গেল লেক পাড়ে।এক জায়গায় লোক ভীড় করে আছে দেখে তারাও এগিয়ে গেল।দেখা গেল নিবিষ্ঠ মনে এক চিত্রশিল্পী ছবি একে চলেছে।তিশিয়ানের বাবা দেখলেন সেই চিত্রশিল্পির হাতে ধরে থাকা তুলিগুলো তার খুব পরিচিত।এতোদিন যে ও গুলো দিয়েই তিনি ছবি আঁকতেন।তিনি কথাটা তুলবেন বলে যখন একটু এগিয়েছেন তখন লোকটি মুখ তুলে তাকালে তাকে চিনতে অসুবিধা হলোনা টিটু সাহেবের।লোকটিকে তো তিনি আগে অনেক বার দেখেছেন।একটা চোর,কতবার চুরি করে ধরা পড়ে পিটুনি খেয়েছে তার হিসেব নেই।সেই চোর কিনা ছবি আঁকছে!তার মানে তার রুমে সেই চুরি করতে ঢুকে রং তুলি চুরি করেছে!
তিনি অবশ্য কিছু বললেন না।মনে মনে ভাবলেন তাওতো ভাল যে লোকটা চুরি ছেড়ে দিয়ে শিল্পী হয়ে উঠেছে।ভাবতেই তার মুখে তৃপ্তীর হাসি ফুটে উঠলো।পাশে হাটতে থাকা তিশিয়ান বাবার মূখে হাসি দেখে বুঝতেই পারলো না বাবা কেন হাসছে।সে বাবার গায়ের সাথে মিশে গিয়ে বাবাকে বললো বাবা তুমি হঠাৎ হাসছো কেন?টিটু সাহেব বললেন আমি হাসছি কারণ তুমি বলেছিলে বাবার হাসি তুমি খুব ভালবাসো তাই হাসি দিলাম।পরে অবশ্য তিশিয়ানকে তিনি পুরো ঘটনাটি বললেন।সেটা শুনে সেও খুব মুগ্ধ হলো।
গল্পঃ তাঁকে কি চোর বলা ঠিক হবে?
#জাজাফী
২৬ জুলাই ২০১৭