নিরুদ্দেশ

এক সকালে আতাহার আলীকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। আতাহার আলী পেশায় পোস্ট মাস্টার। নিশ্চিন্তপুর হাইস্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণী পযর্ন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তারপর সংসারের টানাপোড়েনে আর পড়াশোনা হয়নি। সুযোগ ছিলো তাই পোস্ট অফিসে জয়েন করেছিলেন। পরবর্তীতে পদন্নোতি পেতে পেতে পোস্ট মাস্টার হয়েছেন। বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। কাজের প্রতি তার ছিলো প্রবল টান।

0
243
নিরুদ্দেশ
নিরুদ্দেশ

এক সকালে আতাহার আলীকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। আতাহার আলী পেশায় পোস্ট মাস্টার। নিশ্চিন্তপুর হাইস্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণী পযর্ন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তারপর সংসারের টানাপোড়েনে আর পড়াশোনা হয়নি। সুযোগ ছিলো তাই পোস্ট অফিসে জয়েন করেছিলেন। পরবর্তীতে পদন্নোতি পেতে পেতে পোস্ট মাস্টার হয়েছেন। বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। কাজের প্রতি তার ছিলো প্রবল টান। ঝড় বৃষ্টি যাই হোক অফিসে সময়মতই হাজির হতেন। সেদিন সকাল এগারটা বেজে গেলেও যখন আতাহার আলী পোস্ট অফিসে আসলেন না তখন  প্রথমে মনে হলো তিনি ছুটির দিন ভেবে অফিসে না এসে বাড়িতেই আছেন। অথবা শরীর খারাপ হতে পারে। কিন্তু শরীর খারাপ হলে তিনি কাউকে না কাউকে পাঠিয়ে খবর দিতেন যে আজ আর অফিসে আসতে পারবো না। যেহেতু কেউ খবর নিয়ে আসেনি তাই শরীর খারাপের বিষয়টা সঠিক না। সুতরাং ছুটির দিন ভেবে বাড়িতে থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। অবশ্য সে ক্ষেত্রে তার স্ত্রী নিশ্চই তাকে মনে করিয়ে দিতেন যে অফিসে যাচ্ছ না কেন? তখন হয়তো তিনি বলতেন আজতো ছুটির দিন। এবং আলাপ করতে করতে হয়তো বুঝতে পারতেন আজ ছুটির দিন না। তখন অফিসে দেরি হয়েছে দেখে তড়িঘড়ি করে ছুটে আসতেন। তবে সেটা হলেও এতো দেরি হতো না।

অফিসের পিওন গৌরাঙ্গ খোঁজ নিতে আতাহার আলীর বাড়িতে গেলো। বাড়ি বলতে একটা দোচালা টিনের ঘর আর একটা রান্না ঘর। গরু ছাগলের বালাই নেই বলে গোয়াল ঘর থাকার প্রশ্নই ওঠে না। একজন পোস্টমাস্টারের আর কতইবা বেতন? যা সামান্য আয় তা দিয়ে এর চেয়ে ভালো কিছু করাও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। পিওন গৌরাঙ্গ গিয়ে দেখলো আতাহার আলীর ঘরে তালা দেওয়া। বাড়িতে আতাহার আলীর স্ত্রী এবং একমাত্র কন্যা আতিয়া থাকতো। আতিয়ার বয়স ১০ বছর। স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। অবশ্য আতাহার আলীর পাশে দাঁড়ালে যে কেউ বলবে সে আতাহার আলীর নাতিন। দুজনের বয়সের ব্যবধানই মানুষকে এটা ভাবতে বাধ্য করবে। একটি সন্তানের আশায় বছরের পর বছর কেটে গেছে কিন্তু সন্তান আর হয়নি। শেষ বয়সে এসে তাদের ঘর আলো করে আতিয়া জন্ম নেয়। সেই খুশিতে আতাহার আলী সেবার সারা গ্রামের মানুষকে জিলাপি খাইয়েছিলেন এবং খাশি জবেহ করে সবাইকে আপ্যায়ন করেছিলেন। বাড়িতে তাদেরকেও পাওয়া গেলো না। বোধহয় কোথাও বেড়াতে গিয়েছে। তবে তিনিতো ভুলো মনা মানুষ নন। মানুষ হিসেবে তিনি সবার খুব প্রিয় পাত্র। বিশেষ করে ছোটরা তাকে খুবই ভালোবাসে। অফিস থেকে আতাহার আলী যা আয় রোজগার হয় তা নিজের পরিবারের জন্য খরচ করেন। পাশাপাশি অন্যদের জন্যও কিছু করতে চেষ্টা করেন। দুঃখী অভাবী মানুষের পাশে তিনি যথা সাধ্য দাঁড়াতে চেষ্টা করেন। সেই আতাহার আলী এবং তার পরিবার ভোজবাজির মত হাওয়া হয়ে গেছে। কথাটি চার কান হতে খুব বেশি সময় লাগলো না। ফরিদা বেগমও একসময় খবরটি শুনলেন।

অফিস খোলা অথচ আতাহার আলীর কোনো খোঁজ নেই। সেই সময়ে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলো চিঠি। আতাহার আলী অফিস থেকে ছুটিও নেননি। তাহলে পরিবার সহ লোকটি কোথায় গেলো? এরপর কেটে গেলো পুরো এক সপ্তাহ। কিন্তু আতাহার আলী ও তার পরিবারের কারো কোনো সন্ধান মিললো না। পোস্ট অফিস থেকে থানায় ডায়েরি করা হলো এবং অফিসের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হলো। স্থানীয় পত্রিকায় আতাহার আলীর একটি সাদাকালো ছবি ছাপা হলো। সাথে লেখা হলো বিনোদপুর পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার জনাব আতাহার আলী ও তার পরিবারকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ সন্ধান পেলে পোস্ট অফিসে খবর দিয়ে বাধিত করিবেন।

আতাহার আলী ও তার পরিবারের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্য শুরু হলো। এর মাঝে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এসে তদন্ত শুরু করলো। এলাকায় তার সাথে কারো শত্রুতা ছিলো কি না সেটাও খোঁজ খবর নিলো। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করলো তার মত এমন সাদাসিধে মানুষের শত্রু কোথায় থেকে আসবে। তিনি কারো বাড়া ভাতে ছাই ঢালেননি। তবে আতাহার আলী ও তার পরিবারের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনায়  সবচেয়ে মর্মাহত হলো ফরিদা বেগম। কেননা ফরিদা বেগমের অভাব অনটনের সংসার টিকে ছিলো আতাহার আলীর সহযোগিতায়। বিবাহিত জীবনে দেড় যুগ পার করেও সন্তানের মুখ দেখতে না পারা আতাহার আলী ও তার স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন ফরিদা বেগমকে সন্তানের মতই স্নেহ  করতেন। পরবর্তীতে আতাহার আলীর মেয়ে আতিয়ার জন্ম হলেও তিনি ও তার স্ত্রী ফরিদা বেগমকে আগের মতই স্নেহ করতেন। তাছাড়া ফরিদা বেগম ছিল এলাকার সবচেয়ে দুঃখী মানুষদের একজন। অথচ এই মানুষটির একসময় সবই ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। ফরিদা বেগমের তিন ছেলে মেয়ে। স্বামী বিদেশ গিয়েছিল। মাসে মাসে টাকা পাঠাতো এবং তা দিয়ে সুখে শান্তিতেই দিন কাটছিল। প্রতিবার টাকা আসলেই আতাহার আলী খবর পাঠাতেন। ফরিদা বেগম গিয়ে টাকা এবং চিঠি নিয়ে আসতো। কিছু টাকা জমিয়ে ঘরের কাজ ধরেছিল। তারপর এক ঝড়ে সব কিছু তছনছ হয়ে গেলো।

বিদেশে থাকা অবস্থাতেই ফরিদা বেগমের স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ এলো। পরিস্থিতি এমন ছিলো যে লাশটা পযর্ন্ত দেশে আনা গেলো না। সেখানেই দাফন করা হলো। সেই থেকে ফরিদা বেগমের পরিবারের পাশে ছিলো পোস্টমাস্টার আতাহার আলী ও তার স্ত্রী। তাদের খুব দুঃখ হতো। এই বয়সে মেয়েটি বিধবা হয়ে গেল। তার তিন ছেলে মেয়ে আতিয়ার চেয়েও ছোট। এইটুকু ছেলে মেয়ে নিয়ে বেচারি কিভাবে দিন কাটাবে ভেবে খুব খারাপ লাগতো। ফলে তিনি সাধ্যমত তাদের পাশে থাকতে চেষ্টা করতেন। তাছাড়া ফরিদার বাবা ফরিদ উদ্দিন ছিলো আতাহার আলীর বন্ধু। এক বর্ষায় সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হয়েছিল। আতাহার আলী ও তার পরিবার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় ফরিদা বেগমের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আপনজন বলতে তেমন কেউ নেই অত্র এলাকায়। এমনিতেই অল্প বয়সে বিধবা হওয়ায় তার দিকে মানুষ অন্য চোখে তাকাতো। আতাহার আলী ও তার স্ত্রী তাকে সন্তানের মত আগলে রেখেছিলেন বলে এতোদিন কিছুটা ভালো ছিলো। এখন কী হবে? এই ঘটনার পর ফরিদার জীবনেও অনেক পরিবর্ত আসলো। আগে যেখানে আতাহার আলী চাচা তার নিজের বাজার করার পাশাপাশি ফরিদার জন্যও বাজার করে দিতেন এখন যেহেতু তিনি নেই তাই নিজেদের বাজার নিজেরই করা লাগছে। বাড়িতে বাজার করার মত বড় কেউ নেই। ফরিদা বেগমের বড় ছেলের নাম তৈমুর। তার বয়স ছয় বছর। দ্বিতীয়টার নাম শফিকুল তার বয়স চার বছর আর সবচেয়ে ছোট মেয়ে শরিফার বয়স দুই বছর। এদের কারো বাজার করার মত বয়স হয়নি।

বাজার থেকে ফেরার পথে রোজ বাজে কথা শুনতে হয় ফরিদার। সেই সব কথা শুনে কান পঁচে যায়। মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করে ফরিদার। কিন্তু ছেলে মেয়ের কথা চিন্তা করে কিছু করতে পারে না। সব মেনে নিতে হয়। এই সব বাজে কথা শুরু হয়েছিল স্বামী বিদেশে যাওয়ার পর থেকে। এলাকার বাজে ছেলেরা তার দিকে কু নজরে তাকাতো। তাকে খারাপ ইঙ্গিত দিতো। কিন্তু  ফরিদা ছিলো স্বামী অন্তপ্রাণ। কখনো কারো ইশারায় সে চলেনি। তার দিনকাল বেশ ভালোই চলছিলো। অভাবের সংসারে একটু একটু করে সুখ ফিরে আসছিলো। কিন্তু ফরিদার কপালে বুঝি সুখ বেশিদিন স্থায়ী হবার কথা লেখা ছিলো না। তার স্বামী গিয়েছিল ইরাকে। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সাথে আমেরিকার কী একটা বিরোধের জের ধরে যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধের সময়ও ফরিদার  স্বামী সেকেন্দার সুযোগ পেলেই চিঠি দিতো, টাকাও পাঠাতো। তারপর হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে গেলো। মাস গেলো,বছর গেলো কিন্তু সেকেন্দার  আর চিঠি পাঠালো না,টাকাও পাঠালো না। প্রথম দিকে ফরিদা ভেবেছিল যুদ্ধের কারণে সে হয়তো সময়মত চিঠি পোস্ট করতে পারছে না, মানিঅর্ডার করতে পারছে না।

কিন্তু যখন দুই মাস পেরিয়ে গেলো কিন্তু কোনো চিঠি বা মানিঅর্ডার আসলো না তখন তার মনে কু ডাক দিতে থাকলো। রেডিও টেলিভিশনে রোজই মানুষের মৃত্যুর সংবাদ ভেসে আসতে লাগলো। তাদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশীও ছিলো। যুদ্ধের ভয়াবহতা এতো বেশি ছিল যে যারা মারা গেলো তাদের লাশটাও দেশে ফিরলো না। এর মাঝে সাদ্দাম হোসেন ধরাপড়লো। দিন পেরিয়ে সপ্তাহ পেরিয়ে মাস পেরোলো এবং এভাবে বছর পেরিয়ে গেলো। কিন্তু সেকেন্দারের আর কোনো খোঁজ মিললো না। অনেক মানুষকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হলো। সবার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো যে ওই সব বেওয়ারিশ লাশের মধ্যে সেকেন্দারও একজন। এই ঘটনায় কিছুদিন কান্নাকাটি করে শান্ত হয়ে গেলো ফরিদা। তার এখন বেঁচে থাকার অবলম্বন তিন ছেলে মেয়ে। স্বামীর রেখে যাওয়া আমানত এই ছেলে মেয়েদের সে যে কোনো ভাবেই হোক মানুষের মত মানুষ করবে।

বিধবা হওয়ার পর এলাকার খারাপ মানুষের নজর তার দিকে আরও তীব্র হলো। তার পথ হয়ে উঠলো কন্টকময়। সেই কঠিন সময়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আতাহার আলী ও তার স্ত্রী। আজ তারাও নেই। আতাহার আলী ও তার পরিবার নিরুদ্দেশ হয়েছে এক মাস হতে চললো। কোথাও তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। তবে কিভাবে নিরুদ্দেশ হলো এবং কেন নিরুদ্দেশ হলো সেটা জানা গেল এই ঘটনার আরও কিছুদিন পর। সন্ধ্যার কিছু আগে ফরিদা বেগম তার তিন ছেলে মেয়েকে উঠোনে বসিয়ে রেখে রাতের জন্য রান্না করছিল। চুলায় ভাতের হাড়িতে ভাত রান্না হচ্ছিল। এই ফাঁকে সে তরকারি কেটে রেডি করছিল। আয়োজন তেমন কিছু না। ডাটা শাক আর কয়টা পুঁটি মাছ। মনুমিয়া নকখোলার বিল থেকে মাছ মেরে ফেরার পথে বিক্রি করতে করতে বাড়ি যায়। তার কাছ থেকেই এক পোয়া পুঁটি মাছ কিনেছিল। সেগুলো সে আগেই কেঁটে ধুয়ে একটা বাটিতে রেখেছে। এখন ডাটা শাক আর দুটো আলু কেঁটে ভাতের হাড়ি নামিয়ে তরকারি রান্না করলেই হয়ে যাবে। বাচ্চারা বসে বসে মুড়ি খাচ্ছে। এমন সময় পাশের বাড়ির মুবারক হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে আসলো। মুবারকের বয়স ১০ বছর। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে উঠোনের উপর এসে থামলো। হাপাতে হাপাতে বললো চাচি চাচি চাচা ফিরে আইছে! মুবারকের কথা প্রথমে সে কিছুই বুঝতে পারলো না। কোন চাচা ফিরে এসেছে,কোথা থেকে ফিরে এসেছে তার মাথায় কিছু ঢুকলো না।  ফরিদা বেগম মুবারককে একটু জিরিয়ে ধীরেসুস্থে ঘটনাটা বলতে বললো। মুবারক একটু ধাতস্থ হয়ে ফরিদা বেগমকে যে সংবাদ দিলো তা শোনার জন্য ফরিদা বেগম প্রস্তুত ছিলো না। সে কখনো কল্পনাও করেনি। এর চেয়ে আনন্দের সংবাদ তার জীবনে আগে কখনো আসেনি,ভবিষ্যতেও কখনো আসবে না।

লটারিতে কোটি টাকার পুরস্কার জিতলেও তার মনে এতো আনন্দ হতো না। মুবারক হাপাতে হাপাতে যা বললো সেটা হলো সেকেন্দার চাচা ফিরে এসেছে! সেকেন্দার  চাচা মানে ফরিদার স্বামী! পাঁচ বছর আগেই যে ইরাকের যুদ্ধের সময় মারা গিয়েছিল!সেই থেকে ফরিদা বিধবা হয়ে দিন কাটাচ্ছিল। সেই সেকেন্দার জীবিত আছে এবং দেশে ফিরে এসেছে এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না। ফরিদা বেগম চুলার রান্না চুলায় রেখেই ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে বাড়ির বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। দেখতে পেলো ওইতো দূরে একটা মানুষ তার দিকেই এগিয়ে আসছে আর তাকে ঘিরে আছে গোটা এলাকার মানুষ। গোটা এলাকার মানুষের কাছে এ যেন এক বিস্ময়কর ঘটনা। যে সেকেন্দারকে সবাই মৃত বলে জেনে এসেছে সেই সেকেন্দার জীবিত অবস্থায় ফিরে আসায় গোটা এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘটনার ফলে পোস্ট মাস্টার আতাহার আলী ও তার পরিবার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটা একটু একটু করে চাপা পড়তে শুরু করলো।  

সেকেন্দারকে ঘিরে এলাকার মানুষের দারুণ কৌতুহল। কিভাবে সে মৃত থেকে জীবিত হয়ে ফিরে আসলো এটাই সবার কাছে রহস্য। চারপাশ থেকে নানা জন নানা রকম প্রশ্ন করতে থাকলো। কিন্তু সেকেন্দার কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলো না। সে আপন মনে বাড়ির দিকে হাটতে থাকলো। সেও দেখলো দূরে ফরিদা দাঁড়িয়ে আছে। তার কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা। ওটা নিশ্চই তার মেয়ে শরিফা। যার জন্মের কয়েকদিন আগেই সে বিদেশ  চলে গিয়েছিল। ফরিদার দুই পাশে ছোট ছোট দুইটা ছেলে দাঁড়ানো। দূর থেকে চেনা না গেলেও সেকেন্দারের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ওরা দুজন তার ছেলে তৈমুর আর শরিফুল। হাটতে হাটতে একসময় বাড়ির সামনে চলে আসলো। ফরিদা বেগমের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। এই চোখের পানি আনন্দের। তার জীবনে এর চেয়ে আনন্দের আর কোনো মুহূর্ত কখনো এসেছিল কি না তা সে মনে করতে পারে না। কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রেখে সেকেন্দার দুই হাতে দুই ছেলেকে কোলে তুলে কপালে মুখে চুমু একে দিলেন। তারপর তাদেরকে কোল থেকে নামিয়ে রেখে স্ত্রীর কোল থেকে শরিফাকে নিজের কোলে নিলেন। ছোট্ট শরিফা কিছুই বুঝতে পারছিলো না। কারণ জন্মের পর সে তার বাবাকে কখনো দেখেনি। এতো মানুষের ভীড়ে একজন অপরিচিত মানুষ তাকে কোলে নিচ্ছে দেখে সে ভীত হয়ে ভ্যা করে কেঁদে উঠলো। সেকেন্দার তখন তার কপালে চুমু একে দিয়ে বললো কাঁদেনা মা আমিতো তোমার বাবা। ফরিদা নিজেও তখন শরিফাকে বললো দেখো তোমার বাবা ফিরে এসেছে। একথা শুনে তার কান্না কিছুটা থামলো।

দশবছরের মুবারক সেকেন্দারের ব্যাগটা মাটি থেকে তুলে বাড়ির ভিতরে নিতে চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যাগটা অনেক ভারি হওয়ায় তার একার পক্ষে তা উঁচু করা সম্ভব ছিলো না। পাশ থেকে আরেকজন হাতবাড়ালো। দুজন মিলে ব্যাগের দুই পাশ ধরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলো।

সেকেন্দার কিংবা ফরিদার মনের মধ্যে বলার মত কত শত কথা জমে আছে। কিন্তু চারপাশে এতো মানুষের ভীড়ে সেই সব কথা বলার সুযোগ কোথায়। সে জন্য তাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। সেকেন্দারের সবচেয়ে বেশি বিস্ময় লেগেছে এটা দেখে যে এলাকার সব মানুষ জানে সে মৃত! ইরাক যুদ্ধের সময়ই তার মৃত্যু হয়েছে এবং সেটাও দুই বছর হয়ে গেছে! অথচ এমনটা হওয়ার কোনো কারণই সে খুঁজে পেলো না। তার জীবনের গল্প না শুনে কেউ বাড়িতে যাবে না বলেই যেন পণ করলো। কোনো উপায় না দেখে সেকেন্দার সবাইকে তার গল্প শোনালো। চুলায় তখন অর্ধেক রান্না বাকি। মুবারকের মাকে ফরিদা বেগম অনুরোধ করলো তরকারিটুকু রান্না করে দিতে। এই অবস্থায় সে কিছুতেই রান্না করতে পারছে না। তার অনুরোধে মুবারকের মা রান্না করতে গেলো। যদিও তার ইচ্ছে করছিলো না। তারও সেকেন্দারের জীবনের গল্প শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তবে ফরিদা তাকে বলেছিল ভাবি আমি তুমারে সব খুলে কবানে। সেই আশ্বাস পেয়েই মুবারকের মা ফরিদাদের জন্য তরকারি রান্না করতে গেলো।

এলাকায় বিদ্যুৎ আসেনি।  হারিকেন জ্বালিয়ে সেই আলোয় উঠোনে একটা পাটি বিছিয়ে সেকেন্দার কথা বলা শুরু করলো। তার কথা বলার মাঝেই সবাই বুঝতে পারলো পোস্টমাস্টার আতাহার আলীর নিরুদ্দেশ হওয়ার রহস্য। ইরাকে যাওয়ার পর বেশ ভালোই চলছিল। প্রতি মাসে যা আয় হতো তা থেকে নিজের খরচ চালিয়ে বাকিটা সে দেশে পাঠিয়ে দিত। হঠাৎ করে ইরাকে যুদ্ধ লাগায় সবাই দিশেহারা হয়ে পড়লো। দেশে ফিরে আসার সুযোগ নেই। অনেক টাকা ঋণ করে বিদেশে এসেছে। এখন ফিরে গেলে কিভাবে সেই ঋণ শোধ করবে? তাছাড়া সেই সময়ে যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে বিমান চলাচলও বন্ধ হয়ে গেলো। কেউ কেউ পালিয়ে  পাশের দেশে আশ্রয় নিলো। কেউ কেউ মারা পড়লো। সেকেন্দার যে কারখানায় কাজ করতো একদিন সেখানেও বোমা হামলা হলো। অনেকেই মারা গেলো। তাদের মধ্যে বাংলাদেশেরও অনেকেই ছিল। কিন্ত ভাগ্যক্রমে সেকেন্দার খুব আহত হলেও প্রাণে বেঁচে গেলো। তবে জ্ঞান না থাকায় তার আর তখন কিছু মনে ছিল না। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে নিজেকে আবিস্কার করলো একটি অস্থায়ী হাসপাতালে। রেডক্রসের উদ্ধার টিম হতাহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ্য করে তুললো। পুরোপুরি সুস্থ্য হতে তার প্রায় ছয় মাস লেগে গেলো। এই সময়ে সে কোনো কাজ করতে পারেনি এমনকি বাড়িতে চিঠিও লিখতে পারেনি। সে ইংরেজী পারতো না আবার ওখানে আর যারা ছিলো তারাও বাংলা জানতো না। ফলে মুখে মুখে বললে কেউ তার হয়ে চিঠি লিখে পোস্ট করবে এমন সুযোগও সে পায়নি।

যেহেতু রেডিও টেলিভিশনে অনেক মানুষের মৃত্যুর সংবাদ প্রচার হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশীও ছিল তাই এলাকার মানুষ ধরে নিয়েছিল সেকেন্দারও মারা গেছে। কিন্তু সেকেন্দার একটু থেকে এর পরে যে তথ্য দিলো তা শুনে ফরিদা সহ উপস্থিত সবার চোখ কপালে উঠলো। সুস্থ্য হওয়ার পর সেকেন্দার বাড়িতে চিঠি লিখেছিল এবং সেখানে তার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা বিস্তারিত লিখেছিল এবং সেই সময়ে অল্প কিছু টাকাও  পাঠিয়েছিল। ফরিদা তখন জানালো সে কোনো চিঠি পায়নি এমনকি টাকাও পায়নি। তখনই সবার মধ্যে খটকা লেগে গেল। সেকেন্দার বললো কিন্তু বরাবরের মতই সেই চিঠির জবাব পেয়েছিল সেকেন্দার। সেই চিঠিতে টাকা প্রাপ্তি স্বীকার সহ পরিবার এবং এলাকার অনেক সংবাদও ছিলো। তারপর সে প্রতি মাসে টাকা ও চিঠি পাঠিয়েছে এবং বরাবরের মতই উত্তরও পেয়েছে। অথচ ফরিদা এর কিছুই জানে না! সে তখন জানালো সেকেন্দারের মৃত্যুর খবর শুনে তার পৃথিবীটাই বদলে গেলো। সেই সময়ে আতাহার আলী চাচা ও তার স্ত্রী তার পাশে না দাঁড়ালে ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে তাকে পথে বসতে হতো। সেকেন্দারকে লেখা প্রতিটি চিঠি সে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। সবার মাঝ থেকে উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে সে সেই সব চিঠি নিয়ে আসলো। সবাইকে দেখালো। সবগুলো চিঠিই অবশ্য হতাহত হওয়ার পর সুস্থ্য হয়ে ওঠার পরের সময়কার। স্বামীর হাত থেকে একটা চিঠি হাতে নিয়ে ফরিদা বলে উঠলো এই হাতের লেখাতো আমার না! এটাতো আতাহার আলী চাচার হাতের লেখা!

এ কথা শোনার পর উপস্থিত সবার চোখ ছানাবড়া অবস্থা! তার মানে সব কিছুর মূলে আতাহার আলী! অথচ সবাই তাকে কত ভালো মানুষ মনে করে। ফরিদাকে নিজের মেয়ের মত মনে করে নানা সময়ে সহযোগিতা করেছে! সবাই তখন অনুমান করতে পারে আতাহার আলী ও তার পরিবার কেন নিরুদ্দেশ হয়েছে। বিশেষ করে সেকেন্দার যখন জানালো বাড়ি আসার এক মাস আগেও সে অনেকগুলো টাকা পাঠিয়েছে। সেই সাথে চিঠিতে জানিয়েছে এ মাসের সাতাশ তারিখে সে বাড়ি আসবে। সেই চিঠিটাও আতাহার আলীর হাতেই পড়েছিল এবং সেটা পড়ে যখন সে জানতে পেরেছে সেকেন্দার ফিরে আসছে তখন বিপদ টের পেয়ে পরিবার সহ নিরুদ্দেশ হয়েছে। তখন আর কারো বুঝতে বাকি থাকলো না যে  পোস্টমাস্টার আতাহার আলী আগে থেকেই জানতো সেকেন্দার বেঁচে আছে। কেননা সেকেন্দার সুস্থ্য হওয়ার পর যখন চিঠি লিখেছিল এবং অল্প কিছু টাকা পাঠিয়েছিল তখন সেটা আতাহার আলীর হাতেই পড়েছিল। ততোদিনে এলাকার সবাই জানতো সেকেন্দার মারা গেছে। ফরিদা নিজেও সেটাই বিশ্বাস করে নিজেকে বিধবা হিসেবেই মেনে নিয়েছিল। যে মানুষটা সবার কাছে মৃত সেই মানুষটা জীবিত আছে এবং টাকা পাঠাচ্ছে এটা ভেবে  আতাহার আলীর সরল মনে শয়তান খোঁচা মারলো। উষ্কানি দিলো এই টাকাটা তুমি মেরে দিলেও কেউ কিচ্ছু টের পাবে না। অন্তত সেকেন্দার দেশে ফিরে না আসা পযর্ন্ত কোনো সমস্যাই নেই! ফলে প্রতিবার সেকেন্দার টাকা আর চিঠি পাঠালে সেটা পোস্টমাস্টার আতাহার আলী সরিয়ে ফেলতো আর নিজের মত করে চিঠির উত্তর দিয়ে দিতো। এতে করে সেকেন্দারের মনেও কোনো সন্দেহ তৈরি হতো না। যেহেতু সেকেন্দারের পাঠানো টাকাটা আতাহার আলী হাপিশ করে দিচ্ছে তাই সেখান থেকে কিছু টাকা ফরিদাকে দিয়ে নিজেকে দয়ালু প্রমাণ করতে থাকলো। এতে তার নিজের কাছেও একটু ভালো লাগলো যে পুরোপুরি সে তাদেরকে বঞ্চিত করছে না।

তারপর যখন সেকেন্দার ফিরে আসবে বলে চিঠিতে নির্দিষ্ট তারিখ জানিয়ে দিলো তখন সেই চিঠি হাতে পেয়ে আতাহার আলীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। একবার সেকেন্দার ফিরে আসলে তার সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। এই নিয়ে সে অনেক ভাবলো। তার মনের শয়তান তাকে বারবার উষ্কানি দিচ্ছিল সেকেন্দার ফিরলেই গ্রামে আসার আগেই তাকে খুন করতে হবে। কিন্তু কাউকে খুন করার মত শক্তি বা সাহস কোনোটাই ছিলো না আতাহার আলীর। তেমন কাউকে সে চেনেও না যাকে টাকা দিয়ে এই কাজটা সে সারবে। অগত্য সে পরিবার সহ পালিয়ে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। হাতে তখনো প্রায় এক মাস বাকি। সে ভেবে দেখলো একবার যদি সে পালিয়ে যায় তবে আর ফিরতে পারবে না। আর ফিরতে না পারলে দীর্ঘদিন চাকরিতে যে প্রভিডেন্ডফান্ড জমা হয়েছে সেটাও সে তুলতে পারবে না। একটু খোঁজখবর নিয়ে সে জানতে পারলো আবেদন করলে প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা সে এখনি তুলে নিতে পারবে। সে কিছুদিন দৌঁড়ঝাপ করে কাজটা হাছিল করলো। তারপরই সে পরিবার সহ নিরুদ্দেশ হলো।

সেকেন্দারের জীবনের গল্প শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। এলাকায় উত্তেজনা তৈরি হলো। সেই রাতেই উত্তেজিত জনতা মিলে আতাহার আলীর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল। পরে আর আতাহার আলী ও তার পরিবারের কারো কোনো খোঁজ মেলেনি। দেশে ফেরার আগে মানিঅর্ডার করে সেকেন্দার অন্যবারের তুলনায় অনেকগুলো টাকা পাঠিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিলো বিদেশ যাওয়ার সময় যাদের থেকে ঋণ নিয়েছিল তাদের এখনো কিছু টাকা পাওনা আছে সেগুলো একবারে শোধ করে দিবে। কিন্তু তার সেই আশা পূরণ হলো না। সম্বল বলতে আসার সময় সাথে করে যে টাকাগুলো নিয়ে এসেছিল সেই কটা টাকা। তা দিয়ে সে ঋণও শোধ করতে পারবে না আবার নতুন করে বিদেশেও যেতে পারবে না। সেকেন্দারের মৃত্যুর সংবাদ শুনে লোকে যতটা কষ্ট পেয়েছিল তারচেয়ে বেশি কষ্ট পেলো তার প্রতি যে অবিচার করেছে আতাহার আলী সেটা জেনে। তাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা কারো ছিলো না। যাদের থেকে সে ঋণ নিয়েছিল তারা তাকে আশ্বস্থ করলো যে তাদের পাওনা টাকা নিয়ে এতোটা না ভাবলেও চলবে। সে যে ফিরে এসেছে এলাকার মানুষের জন্য এটাই অনেক বড় বিষয়। বেঁচে থাকলে কোনো না কোনো ভাবে টাকা আয় রোজগার করা যাবে। সেকেন্দারের জীবনের গল্প শুনতে শুনতে রাত গভীর হয়ে গেলো। আকাশে তখন মস্তবড় চাঁদ। সেও বোধহয় দূরে বসে সেকেন্দারের জীবনের গল্প শুনছিল। তারপর সেই দুঃখগাথা শুনে তার মনেও রেখাপাত করলো। একখন্ড কালো মেঘ এসে তাকে ঢেকে দিলো। গোটা পৃথিবী অন্ধকারে তলিয়ে গেল। সেই অন্ধকার হয়তো মেঘ সরলেই কেটে যাবে। কিন্তু সেকেন্দারের জীবনে যে অন্ধকার নেমে এসেছে তা কি কাটবে কখনো? কেউ জানে না। একে একে সবাই যে যার বাড়িতে ফিরে গেলে সেকেন্দার কাপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে ছেলে মেয়েকে পাশে বসিয়ে খেতে বসলো। মনের মধ্যে এতো ঝড় বয়ে যাওয়ার পরও তার ভালো লাগছে। এমন প্রশান্তির খাওয়া কতদিন সে খেতে পায়নি। হাতপাখার বাতাস করতে করতে তার মুখের দিকে অপলোক তাকিয়ে থাকলো ফরিদা বেগম। গতকালও যে বিধবা ছিল!

লেখক: জাজাফী

ইমেইল: [email protected]