বুঝলেন টাকা পয়সার কোন কমতি নেই আমার। সারা জীবনতো আর কম কামাই করিনি। ইংরেজরা এই দেশ থেকে সারা জীবন যতটা লুটেছে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি আমার একার উপার্জন। জীবনে অনেক ইচ্ছেও পুরণ করেছি টাকার বিনিময়ে।
রাতে খাবার খেতে বসে গিন্নি বললো তুমিতো আমার সব স্বপ্নই পুরণ করেছ একটা অন্যরকম ইচ্ছে পুরণ করবে? আমার না অনেক দিনের ইচ্ছে আমি লেখকের স্ত্রী হবো। বউয়ের কথা শুনে আমিতো থ!! কোটি কোটি টাকা তার হাতে তুলে দিয়েছি দেদারসে খরচ করার জন্য আর এখন সেই কী না লেখকের বউ হতে চায়!! শেষ বয়সে আমাকে ডিভোর্স দিতে চায়! আমি বললাম তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে তুমি এই বয়সে লেখককে বিয়ে করবা আর আমাকে ডিভোর্স দিবা!
আমার কথা শুনে বউ বললো তওবা তওবা এ কী কথা বললে তুমি? আমি কোন দুঃখে তোমাকে তালাক দেবো আর সাহিত্যিককে বিয়ে করবো। জীবনে কোন দিন এতো প্যাচের কথা শুনিনি আজ বউয়ের প্যাচলাগানো কথায় আমি নিজেই ঢাকা শহরের বিদ্যুতের পিলারের প্যাচলাগা তারের মত প্যাচ খাচ্ছি। একবার সে বলছে লেখকের স্ত্রী হওয়ার সখ আবার বলছে কোন দুঃখে সে লেখককে বিয়ে করবে। আমি বললাম তাহলে তোমার লেখকের স্ত্রী হওয়ার সখ কীভাবে পুরণ হবে? বউ হেসে দিয়ে বললো আরে টাকা হলে হরিণের চোখ মেলে। শোনো প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির ৩০ তারিখে প্লুটোতে একটা মেলা হয়। সেখানে কবিতা,গল্প,উপন্যাসের পান্ডুলিপি বিক্রি হয়। বেশ অল্প দামেই কেনা যায়। লেখকরা বই লিখে সেটা প্রকাশকদের কাছে নিয়ে গেলে খুব কমজনই তা ছাপে। আর নিজের টাকায় বই ছেপে দেউলিয়া হওয়ার মত লেখকও কম। অন্যদিকে অনেকেরই টাকার অভাব নেই কিন্তু লেখক হওয়ার স্বপ্ন বা ইচ্ছে থাকলেও ক লিখতে কলম ভাঙে। এই দুই শ্রেণীর সুবিধার কথা বিবেচনা করে প্রতিবছর এই মেলাটা হয়। লেখকরা তাদের পান্ডুলিপি নিয়ে বসে থাকে আর যাদের লেখক হওয়ার সখ কিন্তু লিখতে পারেনা তারা আসে পান্ডুলিপি কিনতে।
বউয়ের কথা শুনে খুব মজা পেলাম। এমন মেলাও হয় নাকি!! আশ্চর্য আগে জানতাম নাতো। বউকে বললাম বিস্তারিত বলো। বউ বললো মেলায় পান্ডুলিপি নিয়ে লেখকরা বসে থাকে বিক্রির আশায়। অনেকটা লাউ কদু বিক্রির মত। ক্রেতারা গিয়ে লেখকের সামনে দাড়ায় এবং লেখক নিজের পান্ডুলিপির গল্পের সংক্ষিপ্তরুপ মুখে বলে। প্লট পছন্দ হলে পান্ডুলিপির দরদাম হয়। তোমার কোন গল্প পছন্দ না হলে অন্য লেখকদের গল্প শুনে পছন্দ করতে পারো। একটা পান্ডুলিপি দশ হাজার টাকা থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকাও বিক্রি হতে পারে। লেখক তার পান্ডুলিপি বিক্রি করার পর সেটা যে তার লেখা কোথাও কোনদিন প্রকাশ করে না ফলে ক্রেতা সহজেই সেই পান্ডুলিপি কিনে নিয়ে নিজের নামে ছাপতে পারে আর হয়ে যায় লেখক।
বউয়ের মুখে সব শুনে আমিতো ভীষণ অবাক।তাহলেতো যেতেই হবে একটা পান্ডুলিপি কিনতে। ঢাকায় তিনটা বাড়ি কিনেছি,গাড়ি কিনেছি,পুর্বাচলে জমি কিনেছি,একটা শপিংমল কিনেছি। কানাডাতেও বাড়ি কিনেছি। সুইচ ব্যাংকে টাকা রেখেছি। কোন কিছুর কমতি নেই শুধু ওই ঘরের শোকেসে নিজের লেখা মানে নিজের নাম লেখা কোন বই নেই। বউয়ের বুদ্ধিতে এবার সেটাও হবে। ব্যক্তি জীবনে আমি পুরোপুরি সফল একজন মানুষ হবো। বউকে বললাম তুমিও চলো না হয় আমার সাথে। দেখে শুনে পছন্দ করা যাবে। আর চাইলে তোমার জন্যও একটা দুটো পান্ডুলিপি না হয় কিনে আনবো। বউ সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলো। দুজন দু কাপ চা খেয়ে তবেই বের হবো ভেবে জমিলার মাকে বললাম চা দিতে। জমিলার মা চা দিতে দিতে বললো খালুজান একখান কতা কইবার চাই। আমি বললাম বলো জমিলার মা কী কথা বলতে চাও? জমিলার মা তার পান খাওয়া গাল নাড়াতে নাড়াতে বললো খালুজান এইবার আমারে ঈদবুনাস দেওন লাগবো না। যদি পারেন আমার লাইগাও একখান ফান্ডুলিপি কিন্না আইয়েন। আমারও খুব সখ! জমিলার মাকে কী বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না । আমার স্ত্রী্ই তাকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিলো।
দুজন মিলে অবশেষে ফেব্রুয়ারির ৩০ তারিখে প্লুটোতে পান্ডুলিপির মেলায় গিয়ে বাছাই করে কয়েকটা পান্ডুলিপি কিনলাম। বার বার আসা একটু ঝামেলা তাই একবারে কিনে নিলাম যেন এক এক বছর এক একটা বের করা যায়। হজ্ব করেছিলাম তাই সবাই নামের আগে হাজী জুড়ে দিয়েছিল। দান করেছিলাম তাই দাতা জুড়ে দিয়েছিল। কিছু সমাজ সেবা করেছিলাম শেষে লোকে সমাজসেবক তকমাও দিয়েছিল। এবার সবাইকে জানিয়ে দিলাম আগামী মেলায় আমার নতুন বই বের হচ্ছে সবাই কিন্তু কিনবেন। সবাই এবার আমার নামের আগে লেখক কথাটাও জুড়ে দিলো। কাউকে ভুলেও বলিনি আমার লেখা বই বরং বলেছি আমার বই প্রকাশ হচ্ছে। লেখক শব্দটি জুড়ে দেওয়ার পর নামটা বেশ সুন্দর লাগছে। আমার কিছু অনুরাগী পোষ্টার ছেপেছে সেখানে লিখেছে বিশিষ্ট সমাজ সেবক,জনদরদী নেতা,গরীবের বন্ধু,শিক্ষাবিদ লেখক আল হাজ্ব জাজাফী সাহেবের প্রথম বই ” ফেব্রুয়ারির ৩০ তারিখ” আগামী বই মেলায় প্রকাশ পাচ্ছে। পোষ্টার দেখে বেশ শান্তি শান্তি লাগছে।
একটা পোষ্টার ড্রয়িংরুমে লাগিয়ে রাখলাম। প্রকাশকের সাথে কথাবার্তা হলো তিনি আহ্লাদে গদগদ। আমাকে বললেন কী অসাধারণ লিখেছেন। বিগত দশ বছরেও এতো অসাধারণ বই আমি করতে পারিনি। তবে স্যার ভালো প্রচ্ছদের জন্য আর ভালো কাগজের জন্য খরচাটা একটু বেশি হবে। আমি বললাম কত খরচ হবে? প্রকাশক বললেন এই ধরুন ৪০ হাজার মত। আমি হেসে উঠে বললাম প্রকাশক সাহেব মশকরা করেন আমার সাথে? প্রকাশক জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললেন স্যার কী যে বলেন আপনার সাথে মশকরা করবো কেন?আপনি হলেন সম্মানিত লেখক আর আমি প্রকাশক। যদি টাকার পরিমান বেশি মনে হয় তবে কিছু কমিয়ে ৩৫ হাজার দিয়েন। আমি জানতাম না যে বই প্রকাশে এতো অল্প টাকা লাগে আর পান্ডুলিপি এতো সহজে কেনা যায়। জানলে এতো দিনে অন্তত দুই তিনশো বইয়ের লেখক হয়ে যেতাম।
প্রকাশকের কাঁধে হাত রেখে বললাম প্রকাশক সাহেব চিন্তা করবেন না আমি আপনাকে দেড় লাখ টাকা দিচ্ছি নগদে। আপনি আরাম করে নিজের মত করে ছাপেন। প্রকাশক ভীষণ খুশি। বই মেলা শুরু হওয়ার আগেই মিষ্টির প্যাকেট সহ আমার বাসায় এসে হাজির। সাথে র্যাপিং পেপারে মোড়া কোন উপহার হবে হয়তো। আমাকে জোর করে মিষ্টি খাইয়ে দিয়ে বললেন স্যার র্যাপিং খুলে দেখুন। আমি খুলে দেখি আমার বই!! একদম আমার নামে ছাপা। প্রচ্ছদটাও অসাধারণ হয়েছে। এই প্রকাশক সত্যিই কর্মঠ। পাঁচ কপি বই নিয়ে এসেছে। একটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলাম কেমন ওজনদার হয়েছে বইটা। নাহ পছন্দ হয়েছে। যখন প্রকাশকের সাথে বই নিয়ে গল্প করছিলাম তখন আমার বড় ছেলে ভার্সিটি থেকে ফিরছে। ওকে ডেকে বললাম এই নে খোকা আমার বই বেরিয়েছে পড়ে দেখিস কেমন লাগলো। ছেলে বললো বাবা তোমার বইটা কি তুমি পড়ে দেখেছ একবারও?
ছেলের এহেন কথা শুনে প্রকাশক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি আজীবন ম্যানেজ করা মানুষ সহজেই ম্যানেজ করে নিলাম। বললাম ছেলে বলছে বই আকারে প্রকাশের পর বইটা পড়েছি কি না! প্রকাশক বললেন ও আচ্ছা বুঝেছি। নির্ধারিত দিনে বই স্টলে চলে আসলো। কিন্তু ক্রেতারা কেউ আর আমার বইটা ছুয়ে দেখে না। কী করা যায়? আমার এক চামচা আইডিয়া দিলো। বললো,স্যার আরও কিছু টাকা খরচা করেন দেখবেন বই মেলায় বেষ্ট সেলার হবে। আমি জানতে চাইলাম কী সেই বুদ্ধি। চামচা বললো সভা সমাবেশে যেমন মানুষ ভাড়া পাওয়া যায় বই কেনার জন্যও ভাড়া পাওয়া যায়। তারা মেলায় গিয়ে লম্বা লাইন ধরে আপনার বই কিনবে। শুধু তাই নয় আপনার অটোগ্রাফ নিবে,আপনার সাথে সেলফী তুলবে। সাংবাদিকরাও দেখবে আপনার বই সবথেকে বেশি বিক্রি হচ্ছে।
ওর আইডিয়াটা পছন্দ হলো। জানতে চাইলাম কতজনকে ভাড়া করবা আর খরচ কেমন হবে? আমার এই চামচা না চামচা বলা ঠিক হচ্ছেনা কারণ আমিতো এখন লেখক তাই আমার ভাষা হবে মার্জিত। ওকে তাই চামচা না বলে বলতে হবে আমার সহকারী। আমার সহকারী বললো স্যার প্রতিদিন তিনশোজন করে হিসেব করলে তা ধরুন দশ হাজার মানুষকে আমরা হায়ার করবো। সব মিলিয়ে পাঁচ লাখ টাকা বাজেট হলেই হবে। আমি বুঝলাম আমার এই সহকারী এই টাকা থেকেও মারবে। অবশ্য ওর আর দোষ কোথায়? শিষ্য হিসেবে সে গুরুর কাছ থেকেইতো সব শিখেছে।
মেলার দ্বিতীয় দিনে সকাল সকাল স্টলে গিয়ে বসলাম অটোগ্রাফ দেবো বলে। পরিকল্পনা অনুযায়ি সহকারী ছেলেটা সত্যি সত্যিই লাইন লাগিয়ে দিয়েছে। তারা এক এক করে আসছে আর আমার দিকে বই এগিয়ে দিচ্ছে আমি অটোগ্রাফ দিচ্ছি। সারা মাসে কত হাজার মানুষকে অটোগ্রাফ দিয়েছি তার হিসেব নেই। বইতো বেষ্ট সেলার এটা কনফার্ম। আমার সহকারিকে ধন্যবাদ দিলাম এমন আইডিয়া দেওয়ার জন্য। মেলা শেষে প্রকাশকের সাথে বসলাম বিক্রিবাট্টা কেমন হয়েছে জানার জন্য। তিনি হিসেব করে বললেন আপনার বই ৩০০ কপি ছেপেছিলাম তার থেকে আপনাকে প্রথম দিন উপহার হিসেবে ৫ কপি দিয়েছিলাম আর মেলায় বিক্রি হয়েছে ৫ কপি। বাকি২৯০ কপি গোডাউনে আছে। আপনি যখন বলবেন পাঠিয়ে দেবো।
প্রকাশকের কথা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম। বললাম ভাই পাগল হয়ে গেছেন? দ্বিতীয় দিন থেকে শেষ দিন অব্দি রোজ আমি যে শত শত মানুষকে অটোগ্রাফ দিলাম সেগুলোর হিসেব কোথায়? প্রকাশক বললেন স্যার আপনি ভুল করছেন। আপনি অটোগ্রাফ দিয়েছেন সেটা আমিও স্বীকার করছি তবে অন্য লেখকের বইয়ে অটোগ্রাফ দিয়েছেন। আমার কাছে সিসিক্যামেরার ফুটেজ আছে নিজেই দেখুন। আমি চেক করে দেখলাম সত্যি সত্যিই অটোগ্রাফ দিয়েছি অন্য লেখকের বইয়ে! আসলে ভুলে ওখানে অন্য লেখকের বই রাখা হয়েছিল। ক্রেতা এসে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে ওই বইটা দিন স্যারের অটোগ্রাফ সহ আমরা তাই করেছি। ওখানে আসলে আপনার বই থাকার কথা ছিলো কোন কারনে মিস হয়েছে। আমি বললাম আচ্ছা অসুবিধা নেই আগামী মেলায় আরও নতুন বই আনবো। প্রকাশক বললো স্যার কোন চিন্তা করবেন না আপনার লেখা সেরাদের সেরা। বেষ্ট সেলার হবেই হবে। পাশ থেকে আমার সহকারি বললেন স্যার প্রকাশক সাহেব ঠিকই বলেছেন। আগামী বার দরকার হলে প্রতিদিনের জন্য এক হাজার ক্রেতা ভাড়া করবো। আমি বললাম ঠিক আছে ব্যাপার না। লেখক হয়েছি এটাইতো অনেক। এখন আমার ড্রয়িংরুমে আমার নামে বই আছে এটাইবা কম কিসে।
-জাজাফী
১ জানুয়ারি ২০২১