খুব অল্প জীবন নিয়ে কারো কারো আগমন ঘটে অনেকটা ধুমকেতুর মত।ধুমকেতু ক্ষণস্থায়ী হয় অনেকটা রংধনুর মত কিন্তু সেই সব অল্প জীবন নিয়ে আসা মানুষগুলো যে দীপ্তি ছড়িয়ে যায় তার রেশ যুগের পর যুগ থেকে যায়। সেই যাদুবাস্তবতায় মুগ্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সাহিত্য প্রেমী অগণিত পাঠক।২৩ মার্চ তাই বাংলা সাহিত্যের জন্য হয়ে ওঠে এক বেদনার রঙে রাঙ্গা দিন।
“হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি” কবিগুরুর এই গানের কথাকে সত্য প্রমান করতেই কিনা জানিনা যুগে যুগে অনেক ক্ষণজন্মা মনীষীকে দেখেছি নিভৃতে জীবন কাটিয়েছেন,সবার অলক্ষ্যে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সেই ধারায় প্রথম যে নামটি আমরা দেখতে পাই তিনি জীবনানন্দ দাশ।তার চলে যাবার পর ধীরে ধীরে তিনি ক্রমাগত ভাবে নতুন রুপে আবিস্কৃত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। তার ফেলে যাওয়া জংধরা ট্রাংকটি তাই হয়ে ওঠে সাহিত্য প্রেমীদের কাছে আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতই। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে অমূল্য সব সাহিত্য।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর সম্ভবত জীবনানন্দ দাশের কবিতাই সর্বাধিক পঠিত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে রবী ঠাকুরের কবিতার চেয়েও তার কবিতা হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়তম।
জীবনানন্দ দাশের মতই নিভৃত জীবন,অলক্ষ্যে মৃত্যু অতঃপর ধীরে ধীরে আবিস্কৃত হচ্ছেন যে মানুষটি তিনি কেবলই একজন সাহিত্যিক নন বরং সাহিত্যের বোদ্ধা পাঠকদের চোখে তিনি যাদু বাস্তবতার কারিগর।তিনি শহীদুল জহির।১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ তে যার জন্ম হয়েছিল।
শহীদুল জহিরকে প্রথম চিনেছিলাম শ্রদ্ধাভাজন লেখক “শাহাদুজ্জামান”র লেখা “লেখালেখি” বইটি পড়তে গিয়ে। সেই প্রথম শহীদুল জহির সম্পর্কে জানতে পারি। শাহাদুজ্জামান একজন শক্তিমান লেখক হিসেবে শহীদুল জহিরকে তার ছোট্ট প্রবন্ধটিতে সুন্দর ভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। “ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প” এর এই লেখক মাত্র ৫৫ বছরের এক ছোট্ট জীবন নিয়ে আমাদের মাঝে এসেছিলেন। ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ যখন তিনি সবার অলক্ষ্যে চিরদিনের মত চলে গেলেন অন্য ভূবনে, তখনো তাকে খুব একটা মানুষ চিনতো না। যদিও তার লেখক জীবনের বিস্তৃতি ছিল প্রায় ত্রিশ বছরের কিছু অধিক।
লেখালেখিতে ছিল তার প্রচন্ড ভালবাসা।একটা লেখা লিখতে তিনি নিয়েছেন ব্যপক প্রস্তুতি। তাইতো আমার দেখতে পাই তার প্রথম বই প্রকাশ পায় ১৯৮৫ সালে। এক বই মেলাতে “দীপু মাহমুদ” “তৌহিদুর রহামন” “মোশতাক আহমেদ” “ইমদাদুল হক মিলন” যেখানে আট দশটি বই বের করছেন সেখানে ত্রিশ বছরের লেখক জীবনে শহীদুল জহিরের মোট বই সংখ্যা মাত্র ৭টি। হালের নাম ধারী প্রচার সর্বস্ব লেখকরা যেখানে বছরে দশ বারোটা বই লিখেছেন সেখানে শহীদুল জহিরের সারা জীবনের রচনাও সেই এক বছরের লেখার সংখ্যাকে ছাড়াতে পারেনি।
কিন্তু সংখ্যাধিক্য নয় বরং সাহিত্য মান বিচারে হালের অধিকাংশ সাহিত্যিককে যোজন যোজন পিছনে ফেলে হিমালয় সমান উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তার যাদুবাস্তবতার মিশেলে অনন্য সব সাহিত্যকে।আমার দেখতে পাই তার জীবদ্দশায় ৬টি গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছিল। তার রচিত সাতটি গন্থের মধ্যে চারটি উপন্যাস আর তিনটি গল্প সংকলন।
মাত্র ৭টি গ্রন্থ দিয়েই বাংলা সাহিত্যের ভূবনে তার স্বতন্ত্র স্থান নিশ্চিত করে গিয়েছেন শহীদুল জহির। অন্য অনেক লেখক একশোর অধিক বই লিখেও শহীদুল জহিরের সাহিত্য মানের এক ছিটেফোটা অংশও অর্জন করতে পারেনি।এখানেই শহীদুল জহির অনন্য।
শহীদুল জহির অনন্য তার ভাষা ও বর্ননাভঙ্গীর সাবলিলতা ও মায়াবি ব্যবহারে। সম্পূর্ন অভিনব ও ভিন্নধর্মী তার ভাষার ব্যবহার ও কাহিনীর বর্ননাভঙ্গী। শহীদুল জহির ও তার সাহিত্যকে তাই মেলানো যাবে না বাংলা সাহিত্যের আর কোন লেখকের সাথে। তার কোন পূর্বসূরীকেই তিনি প্রতক্ষ্যভাবে এমনকি অবচেতন ভাবেও অনুসরণ করেননি। সম্পূর্ন নতুন পথে হেটেছেন তিনি। পুরনো সব প্রথা ডিঙিয়ে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করেছেন সম্পূর্ণ নিজের মত করে।
শহীদুল জহিরের ছিল গল্প বলার নতুন ভঙ্গি। পাঠক যখন তার কোন গল্প নিয়ে বসে তখন অবাক হয়ে দেখে তার গল্পের ভিতরে অসাধারণ কোন কাহিনী নেই। কিন্তু তার ভিন্নধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি ও উপস্থাপন সাধারন একটা কাহিনীর মাঝ থেকে বের করে আনে অসাধারণ কিছু। তিনি যেভাবে দেখেছেন সেভাবে পাঠক না দেখেছে তার নিজের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে, না দেখেছে অন্য কোন লেখকের চোখে।
শহীদুল জহিরকে বলা হয় উত্তর-আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রুপকার। বাংলা সাহিত্যে যাদু-বাস্তবতার প্রথম সার্থক প্রয়োগ হয় তার হাত ধরেই। অনেকের মতে তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’র কথা। অদ্ভুত ভাললাগার এক কুহকী জগৎ তিনি চিত্রায়ন করেছেন উপন্যাসটিতে। যে জগতের মায়াময় গোলকধাঁধায় পাঠক ঘুরপাক খেতে থাকে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে।
শহীদুল জহিরের প্রথম উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’। আপাত দৃষ্টিতে হয়তো খুবই সাদামাটা একটা নাম। এই সাদামাটা নামের ভিতরে আছে মুক্তিযুদ্ধের উপরে লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি উপন্যাস। এখানেও আছে শহীদুল জহিরের পরশপাথর ‘অভিনব দৃষ্টিভঙ্গি’। মুক্তিযুদ্ধকেও তিনি তুলে ধরেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। আবেগের বিন্দুমাত্র আতিশয্যে না যেয়ে সম্পূর্ন নির্মোহভাবে একত্তরের ভয়াবহতাকে তার মত কেউ প্রকাশ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
তিনি পুরান ঢাকার ভাষাকে এমন সাবলিল ভাবে ব্যবহার করেছেন যা পড়লে মুগ্ধতার রেশ আর কাটেনা।
‘‘আমাদের মহল্লা, দক্ষিণ মৈশুন্দির শিল্পায়নের ইতিহাস আমাদের মনে পড়ে; মহল্লায় গরম পড়তে শুরু করলে চৈত্র, বৈশাখ অথবা জ্যৈষ্ঠ মাসে তরমুজওয়ালা তরমুজ নিয়ে আসে এবং আমরা তরমুজ খেতে শুরু করি,’’
এখানের এই আখ্যানকারি ‘আমরা’ কখনো বা একদল স্কুল পড়ুয়া কিশোর, কখনোবা একদল কারখানার শ্রমিক। একই সাথে অতীতের, বর্তমানের ও ভবিষ্যতের পথে বিচরন করছে। ব্যক্তি ও কালের এই আন্তর্পরিভ্রমণ তার অনেক লেখাতেই পাওয়া যায়।
কারো কারো মতে শহীদুল জহিরের লেখায় বাংলা সাহিত্যের কোন পূর্বসূরীদের প্রভাব তেমন একটা না থাকলেও মার্কেজের প্রভাব আছে। কিন্তু সেই প্রভাব অনুকরণের পর্যায় যায় নি কখনো, অনুপ্রেরণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যাদু-বাস্তবতার ভাবনাটাই শুধু নিয়েছেন। ভাষা থেকে শুরু করে কাহিনী, চরিত্র সবকিছুই তার নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতায় উদ্ভাসিত।
শহীদুল জহির জীবদ্দশায় জনপ্রিয় ছিলেন না। নিভৃতচারী এই মানুষটি খুব একটা পরিচিতও ছিলেন না। কখনো জনপ্রিয় হওয়ার জন্য চেষ্টাও নি। হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন তাকে গ্রহণ করার জন্য এখনো রূচিগতভাবে প্রস্তুত নয় বাংলাদেশি পাঠকেরা। আজকের এই আধুনিক যুগে এখনো যে তিনি খুব পরিচিত হয়েছেন বলা যায় না। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তার পরিচিতি দিনদিন বাড়ছে। তিনি আবিষ্কৃত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত, মূল্যায়ন পাচ্ছেন। অথবা বলা চলে স্বর্ণকে কেউ স্বর্ণ বলে মেনে না নিলে যেমন স্বর্ণের স্বর্ণত্ব বিলোপ হয়না তেমনি শহীদুল জহিরও হারিয়ে যেতে পারেন না।
তার রয়েছে নিজস্ব পাঠক গোষ্ঠী। নতুন কোন পাঠকের হাতে যখন তার বই উঠছে ক্রমাগত ভাবে সেও হয়ে উঠছে শহীদুল জহিরের একান্ত পাঠক।
বাজারের লেখক বলে প্রচলিত কথাটি কখনোই শহীদুল জহিরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিলনা। তিনি লিখতেন আপন মনে আপন ভঙ্গিমায়। তাইতো তার লেখার সংখ্যাও সর্বসাকুল্যে মাত্র ৭টি বইয়ে সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। প্রচলিত ধারার বাইরে আমাদের বাংলা সাহিত্যে যারা একটু অভিনবত্ব এনেছেন, দুঃখজনকভাবে তাদের লেখার সংখ্যা বেশ কম। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির সবাই লিখেছেন কম কিন্তু উপহার দিয়েছেন নতুন কিছু। হায় আফসোস তাদের জীবনকালও তাদের লেখার সংখ্যার মতই ছিল।
আমরা যখন তার “ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প” বইটি হাতে নেই দেখতে পাই সাদামাটা রোজকার কিছু কথাবার্তা তিনি এমন ভাবে তুলে ধরেছেন যে পাঠক মাত্রই মুগ্ধ হয়ে আছেন।যেতে নাহি দিব হায় তবু যেতে দিতে হয়,তবু চলে যায়।
শহীদুল জহিরও চলে গেলেন। সমকালীন জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হক তার “লেখা নিয়ে লেখা” বইটিতেও শহীদুল জহিরকে নিয়ে লিখেছেন।অন্য আরো অনেকেই শহীদুল জহির ও তার সাহিত্য কর্ম নিয়ে লিখছেন। সময় এসেছে এই ক্ষণজন্মা সাহিত্যিককে লাইম লাইটে নিয়ে আসার। তার রেখে যাওয়া অসাধারণ সাহিত্যকর্মকে সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেওয়া। সাহিত্য প্রেমীরা দেখুক বাংলা সাহিত্য কোন মানের একজন লেখককে হারিয়েছে।
আরো বছর বিশেক বাঁচলে কি হতো, কম করে হলেও আরো গোটা পাঁচেক বই আমাদের উপহার দিয়ে গেলে কি হত! কিন্তু ওপারের ডাক সম্ভবত তিনি আগেই শুনতে পেয়েছিলেন কিংবা শুনতে চেয়েছিলেন।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পর তিনিই সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে ভিন্ন ধারার একটি স্রোত তৈরি করেছিলেন।
আট বছর আগে আজকের এই দিনে তিনি চলে গিয়েছিলেন। কী আশ্চর্য তখনোতো আমি টিএসসি,শাহবাগ দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি,তখনোতো আমি বারডেমে ঘুরেছি। কিন্তু এই যাদুবাস্তবতার কারিগর এতো কাছে থাকার পরও তাকে ধরতে পারিনি, তিনি থেকেছেন তার নিজস্ব যাদুবলয়ে। তারাশঙ্করের কবি উপন্যাসের সেই কথাটি বার বার মনে পড়ছে “জীবন এতো ছোট কেনে”
শহীদুল জহির চলে গেছেন না ফেরার দেশে কিন্তু রেখে গেছেন এমন কিছু যা সাহিত্য মান বিচারে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে যোগ করেছে কোহীনুরের মত এক অমূল্য রতন।শহীদুল জহিরেরা তাই মরে গিয়েও বার বার ফিরে আসে পাঠকের হৃদয়ে ভালবাসা হয়ে।
…………………………………………
২৫ মার্চ ২০১৬,গ্লোবালপোষ্ট।