যা বলতে চাই সেটা বলার আগে একটা গল্প বলি। এই গল্পটা হয়তো আগেই বলেছি বা আপনারা আগেও শুনেছেন। এক সরকারি কর্মকর্তার ইচ্ছে হলো একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলবেন। সে জন্য তিনি যোগাযোগ করলেন এক কোম্পানীর সাথে। তারা তাকে জানালো ইউটিউব চ্যানেল খুলতে মোট ৫ লাখ টাকা লাগবে। তিনি ভাবলেন এতো টাকা! তার কাছে তখন অতো টাকা ছিলো না। তিনি সময় নিলেন। অল্প অল্প করে টাকা জমালেন। চার লাখ টাকা জমানোর পর একদিন অফিস শেষে ফেরার পথে চায়ের দোকানে বসে তার ইচ্ছের কথা তার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছোট ভাইকে বললেন। ছোট ভাইটা সব শুনে অবাক হলো। তার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে একটু টেপাটিপি করে তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন ভাই এই নিন আপনার ইউটিউব চ্যানেল খোলা হয়ে গেছে। লোকটি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলেন সত্যি সত্যিই তার নামে একটা ইউটিউব চ্যানেল খোলা হয়ে গেছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন কিভাবে করলে? চ্যানেল খুলতে না ৫ লাখ টাকা লাগবে ওরা বললো? তখন ছেলেটি হেসে উঠলো। বললো ভাই এগুলো হলো মেরে খাওয়ার ধান্দা। এই গল্পের সারকথা হলো আমরা যে সব প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করি তা ওরকম বিভিন্ন মাধ্যমে করি বলি আমাদের খরচ হয় আকাশ ছোঁয়া। নিজেরাই যদি এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারতাম তবে খরচের পরিমান অনেক কমে যেতো। আমরা যে মুখে মুখে বলি মানব সম্পদ আসলে কি আমরা সেটা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করি? আমরা কি কখনো সত্যি সত্যিই মানব সম্পদকে সম্পদে পরিনত করতে চেষ্টা করেছি? তাহলে আজকে আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রজেক্ট করার জন্য বিদেশীদের ভাড়া করা লাগতো না। আমাদের সম্পদ অন্য দেশে চলে যেতো না।
যে দেশে এতো বেকার, বেকারত্বের অভিশাপ দূর করতে অন্যান্য দেশে গিয়ে আমরা শ্রম দিচ্ছি সেই দেশে বাইরের দেশের মানুষ এসে কিভাবে চাকরি করে? পুলিশ বাহিনীতেও নাকি ভারতীয় অনেক নাগরিক আছে এবং সেই সংখ্যাটাও চোখ কপালে ওঠার মত। অন্যদিকে শুনি বড় বড় প্রজেক্টে দক্ষ লোক পাওয়া যায় না বলে বিদেশ থেকে লোক ভাড়া করা লাগে। এই যে দক্ষ লোক পাওয়া যায় না এর জন্য দায়ী কে? আমরা নিজেরাই। আমাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় তাহলে আমাদের ছেলে মেয়েদের কী শেখায় যে তাদের মধ্যে চাহিদা মত দক্ষতা গড়ে ওঠে না? আমরা যেহেতু জানি যে আমাদের কোন ধরনের দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ দরকার আমরা তাহলে কেন সেগুলোকে আমলে নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের সেই সব বিষয়ে দক্ষ করে তুলি না? তাহলেইতো এই বিরাট সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। দেশের টাকা দেশেই থাকে এবং একই সাথে প্রজেক্ট বাস্তবায়ন খরচ চার ভাগের তিন ভাগ কমে যায়। পাশাপাশি দেশের বেকারত্ব শুণ্যের কোটায় নেমে আসে।
সারা পৃথিবী যেখানে শিক্ষা ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দিয়ে মানবকে সম্পদে পরিনত করায় ব্যস্ত আমরা তখন কোন পথে হাটছি? আমরা বছরের পর বছর দলীয় লেজুড়ভিত্তিক অপশাসনের মাধ্যমে প্রতিটি সেক্টরকে সীমাহীন দুর্নীতির কারখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে চলেছি। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় সিন্ডিকেট সব জায়গায় লুটেরা সব জায়গায় দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন চলছে। এগুলোর অবসান হওয়া জরুরী। দেশকে সত্যিকার অর্থে উন্নত করতে চাইলে এর বিকল্প কিছু হতে পারে না। আমাদেরকে সত্যি সত্যিই টেকসই উন্নয়নের চিন্তা করতে হবে।
বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার সব সময়ই কিছু চাওয়া ছিলো, দাবী ছিলো এবং অধিকার ছিলো। সেই চাওয়া আমি চাইতে পারিনি, সেই দাবী আমি করতে পারিনি, সেই অধিকার আমি পাইনি। বুঝতে শেখার পর থেকে আমি কখনো আমার স্টেটমেন্ট বদলাইনি। বয়স বেড়েছে, সরকার বদল হয়েছে, হাওয়া বদলে যেতে দেখেছি কিন্তু আমার স্টেটমেন্ট বদলায়নি।
আমাদের দেশের সীমিত সম্পদ এবং সীমিত ভূখন্ডকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগাতে হবে। মানব সম্পদকে সত্যিকার অর্থে সম্পদ রুপে গড়ে তুলতে হবে। দেশেই দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে যেন দেশের যে কোনো প্রজেক্ট দেশের মানুষের মাধ্যমেই সম্পন্ন করা সম্ভব। এতে করে খরচ অর্ধেকের চেয়েও কমে আসবে।
আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু এখন এই দেশে কৃষকের সংখ্যাই সবচেয়ে কম। কৃষিখাতে প্রচুর ভর্তুকি দিলেও সেই সুবিধা আসলে প্রান্তিক কৃষকেরা ভোগ করতে পারে না। এই দেশে কৃষকদের মূল্যায়ণ জরুরী। আমাদের কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। সার ওষুধ কীটনাশকের দাম সীমিত রাখতে হবে। খাদ্যপণ্যের দাম তাহলে অটোম্যাটিক কম থাকবে। যদি সিন্ডিকেট না থাকে। কৃষিতে ব্যবহৃত পণ্যের দাম যদি কম থাকে তাহলে উৎপাদন খরচ কমে যাবে ফলে উৎপাদিত পণ্যের দামও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে।
ধান,গম, শাক সজবির বাইরে পাট,তুলা সহ অন্যান্য পণ্যের দাম বেশি হতে হবে কারণ ওগুলো দিয়ে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো কাজ নেই। ওগুলো শিল্প মালিকেরা নিয়ে কাপড়,সুতা,কার্পেট অনেক কিছু বানিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করে। সেই তুলনায় কৃষকেরা দাম পায় না। চামড়া শিল্পে সিন্ডিকেট দূর করতে হবে। আমরা সবাই জানি চামড়াযাত পণ্যের দাম আকাশ ছোয়া। কিন্তু চামড়া বিক্রির সময় আমরা দেখি দামই পাই না। একটা গরুর চামড়া থেকে ১০/২০ জোড়া জুতা হয়। যার দাম দাড়ায় লাখ টাকা। কিন্তু সেই চামড়া বিক্রি হয় ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে। এই সব অরাজকতা দূর করতে হবে।
রাস্তায় ট্রাফিক আইন একেবারেই বলবৎ না। সে ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমান বাড়ানো উচিত। একবার জরিমানা দিলে ওই লোক সারা জীবন মনে রাখবে এবং ভবিষ্যতে আর কখনো আইন ভাংবে না। ঘুষ নিয়েছে এমন প্রমাণ হলে শুধু চাকরি থেকে বহিস্কারই নয় পাশাপাশি জেল জরিমানার ব্যবস্থা থাকতে হবে। একজন অফিসার নিজ থেকে জীবনের শুরুতেই ঘুষ চায় না বরং সেবাগ্রহীতা দ্রুত সেবা পাওয়ার জন্য নিজ থেকেই ঘুষ দিতে উদ্যোগি হয়। তারপর এটা এক সময় সেবা দাতার অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন সেবা গ্রহীতার আর ঘুষ দেওয়ার কথা বলা লাগে না বরং তার থেকে ঘুষ জোর করে নেওয়া হয়।
সরকারি চাকরি বিশেষ করে বিসিএস কেন্দ্রীক যে ঝুকে পড়ার বিষয় এটা দূর করতে হবে। তাহলে দেশের বেকারত্ব কমবে। তাছাড়া একাডেমিতে পড়াশোনার সময় শিক্ষকদের ভূমিকা পালন করতে হবে। ছাত্রদের মধ্যে স্বপ্ন তৈরি করতে হবে, স্কিল ডেভেলপ করতে হবে, আত্মবিশ্বাসের বুনিয়াদ গড়ে দিতে হবে।
টাকা থাকলেই তাকে দলীয় নমিনেশন দেওয়া যাবে না বরং এলাকাভিত্তিক জনপ্রিয়তা যাচাই করতে হবে একই সাথে মানুষটি সৎ কি না সেটাও যাচাই করতে হবে। এলাকার মানুষ বলবে অমুককে প্রার্থী হিসেবে চাই। এভাবে নানা এলাকার মানুষ বলবে। সেইসব প্রার্থীদের মধ্যে আবার কে সেরা তা যাচাই করে তারপর নেতা নির্বাচন করতে হবে। সারা দেশের মানুষ চায় কি না সেটা যাচাই না করে কোনো আইন বা বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। প্রথমে জনসাধারণের সামনে বিষয়টি উত্থাপন করতে হবে যে আমরা অমুক কাজটি করতে চাই। ধরে নিচ্ছি একটা বিশ্ববিদ্যালয় বা একটা টিভি চ্যানেল চালু করতে চাই। তো আগেই ঘোষণা দিয়ে জনমত যাচাই করে পক্ষে গেলে তা অনুমোদন পাবে আর বিপক্ষে গেলে তা বাতিল হবে।
সর্বস্তরের শিক্ষকদের বেতন ও সম্মান বাড়াতে হবে। বিশেষ করে যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর সবচেয়ে মেধাবীদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক লেভেলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। সেটা বিসিএস ক্যাডারের মাধ্যমেই হোক বা অন্য কোনো উপায়ে।
জিনিসপত্রের দাম বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আগে কেনা পণ্যের মজুদ দাম বাড়ার সাথে বাড়তি দামে বিক্রির প্রবণতা ঠেকাতে হবে। ইলিশ মাছতো চাষ করতে হয় না বা ইলিশ উৎপাদনে কোনো খরচও নেই। তাহলে ইলিশের এতো দাম কেন? কারণ যে জেলে মাছ ধরে জালও তার না নৌকাও তার না। ফলে সিন্ডিকেট বা মহাজনি কারবারের মাধ্যমে এর দাম বাড়ে। সরকারি ভাবে জেলেদের নৌকা ও জালের ব্যবস্থা করে দিতে হবে যেন ইলিশের দাম আগের মত হয়। সবাই মাছে ভাতে বাঙ্গালী এটা আবার বিশ্বাস করতে পারে।
দেশের নদীগুলো খনন করতে হবে। নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। নৌ যোগাযোগ উন্নত করতে হবে।
পোস্ট অফিসগুলোকে সচল করতে হবে। দেশের আনাচে কানাচে পোস্ট অফিস থাকায় মানুষের ঘরে ঘরেসেবা পৌছে দেওয়া সম্ভব। সেটা কেন হচ্ছে না? কুরিয়ার সার্ভিসগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করছে যা পোস্ট অফিসের মাধ্যমে আরও সুন্দর সেবার মাধ্যমে সরকার নিজের ঘরে তুলতে পারতো। কুরিয়ারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডেলিভারির সুযোগ না থাকলেও পোস্ট অফিসে সেটা ছিলো।
মোবাইল কোম্পানীগুলোর মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশী কোম্পানী নিয়ে যাচ্ছে। অথচ টেলিটক বলে যে দেশী প্রতিষ্ঠান আছে সে অর্থবর মত বসে আছে। তাদের সেবার মান জঘন্য। এটা বাড়িয়ে গ্রাহকবান্ধব করতে হবে যেন দেশের টাকা দেশেই থাকে।
তেলবাজ,চাটুকারদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স হতে হবে। সীমান্তে হত্যাকান্ড বন্ধ করতে হবে। সব রকম চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। আরও কত শত চাওয়া আছে, দাবী আছে। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু চাওয়া আছে। আমরা সেই সব চাওয়াগুলো একত্র করে কমনগুলো বাছাই করতে পারি। এরকম ১০০ টি বিষয়কে যদি আমরা বেছে নিয়ে সেগুলো সফল করতে চেষ্টা করি তবে সেই বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ।
১৫ আগস্ট ২০২৪