আপনাদের চোখে পড়েছে কি না জানিনা, কয়েকদিন আগে ক্ষমা চাওয়া বিষয়ক একটি পোস্ট ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছিল বলা হয়েছে, গীবতকারীকে লাইলাতুল কদরেও ক্ষমা করা হবে না যতক্ষণ না সে তার (যার নামে গীবত করা হয়েছে) কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এর পর পরিচিত অপরিচিতদের কাছে ক্ষমা চেয়ে কিছু কথা লেখা হয়েছিল। সেই লেখাটি আমি অনেকের ফেসবুক টাইমলাইনে দেখেছি এবং অনেকে আমাকে ইনবক্সে পাঠিয়েছেন। আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এই ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা করা নিয়ে কিছু কথা লিখবো বলেই এই লেখাটি শুরু করেছি। যদি কারো ধৈর্য থাকে তবে পুরো লেখাটি পড়বেন হয়তো এমন কিছু জানতে পারবেন যা আপনি আগে জানতেন না অথবা আগে জানতেন কিন্তু আরও একবার জানলেও ক্ষতি নেই। সেই কথাগুলো বলার আগে আমি আমার সেই বন্ধুটির কথা বলতে যাই যে আমাকে ফোন করে এই বিষয়ে লেখার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। লেখার শুরুতেই নবীজী সা. এর সময়ের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই।
একদিন নবীজী (সা.) সাহাবীদের নিয়ে মসজিদে নববীতে বসে আছেন। সবার মনে তাঁর কথা শোনার আগ্রহ। নবীজী বললেন,
يَطْلُعُ عَلَيْكُمُ الْآنَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْجَنّةِ.
‘তোমাদের মাঝে এখন আসবে একজন জান্নাতী মানুষ।’ নবীজীর মুখে একথা শুনে সবাই খুব উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন, সেই সৌভাগ্যবান মানুষটি কে- তা দেখার জন্য। ইতিমধ্যে একজন আগমন করলেন, যিনি সবেমাত্র ওযু করেছেন। দাড়ি বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে। জুতা জোড়া বাম হাতে ভাঁজ করা। ধীরে ধীরে মসজিদের দিকে আসছেন। এ দরোজা দিয়েই প্রবেশ করলেন তিনি নবীজীর মজলিসে শরীক হওয়ার জন্য।
দ্বিতীয় দিন। সবাই নবীজীকে ঘিরে বসে আছেন। নবীজী গতকালের মতই বললেন- ‘এখন তোমাদের মাঝে একজন জান্নাতী মানুষের আগমন ঘটবে।’ দেখা গেল এই দিনও সেই মানুষটিকেই আগমন করতে।
তৃতীয় দিন। গত দু’দিনের মত আজও নবীজী (সা.) বললেন সে একই কথা। দেখা গেল নবীজীর কথার পর সেই মানুষটিই মজলিসে আগমন করলেন।
কে এই সৌভাগ্যবান, যিনি তিন তিনদিন তিন তিনবার নবীজী (সা.)-এর মুখে জান্নাতী হওয়ার সনদ পেলেন? তিনি হচ্ছেন হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা.।
হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা.। কেমন ছিলেন তিনি? কী ছিল তাঁর গুণ ও বৈশিষ্ট্য? নবী (সা.) যাঁর সম্পর্কে এই সুসংবাদ দিলেন তার পরের জীবনটুকু কীভাবে কেটেছে? সংক্ষেপে বললে তিনি ছিলেন নবীজীর অত্যন্ত প্রিয় ও বিশ্বস্ত সাহাবী। নবীজী তাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনিও নবীজীকে ভালবাসতেন প্রাণ দিয়ে। মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি ইসলাম কবুল করেন। তাঁর ইসলাম কবুলের বিবরণও খুবই চমৎকার। দ্বীন-ঈমানের জন্য অতুলনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি। জিহাদের ময়দানে ছিল তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্য। নবীজী তাঁর সমরকুশলতার প্রশংসা করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম শত্রুর বিরুদ্ধে তীর নিক্ষেপ করেছেন।
যে ঘটনাটি বলছিলাম- নবী (সা.)-এর মুখে হযরত সা‘দ রা. সম্পর্কে এই মহা সুসংবাদ ঘোষিত হওয়ার পর যা ঘটল; মজলিস শেষে হযরত সা‘দ রা. যখন বাড়ির পথে রওয়ানা হলেন তখন সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. তাঁর পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন। তাঁর মনে একটিই চিন্তা হযরত সা‘দ রা. কী আমল করেন? কোন আমলের গুণে তিনি এই মহা সৌভাগ্য অর্জন করলেন- তা তাকে জানতেই হবে। তিনি হযরত সা’দ রা.কে বললেন তিনি তার বাড়িতে তিনদিন থাকতে চান। সা’দ রা. বললেন ঠিক আছে, থাকো। কোনো অসুবিধা নেই। সম্পর্কে সা’দ রা. তার চাচা হন।
হযরত আবদুল্লাহ একে একে তিন রাত হযরত সা‘দের বাড়িতে রইলেন। কৌতুহলের এ তিনরাতে তিনি যা কিছু আবিষ্কার করতে পারলেন তা তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন-
“আমি তিন রাত কাটালাম। তাঁকে রাত জেগে জেগে তাহাজ্জুদও তেমন পড়তে দেখলাম না। তবে রাতে ঘুম ভাঙ্গলেই পাশ ফেরার সময় আল্লাহু আকবার বলতেন; আল্লাহর যিকির করতেন; এরপর ফজরের সময় হলে নামাযের জন্য উঠে পড়তেন।
তবে এ তিন দিন তাঁকে কোনো অর্থহীন শব্দ বা বাক্য বলতে শুনিনি। শুধু ভালো কথাই বলতে দেখেছি।
তিন রাত কাটানোর পর তাঁকে বললাম- চাচা, আব্বার সাথে আমার রাগারাগির কিছু ঘটেনি। শুধু আপনার সাথে কিছু সময় থাকা এবং আপনার আমল পর্যবেক্ষণ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। কারণ পর পর তিন দিন আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন,
يَطْلُعُ عَلَيْكُمُ الْآنَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْجَنّةِ.
‘এখন তোমাদের মাঝে একজন জান্নাতী মানুষের আগমন ঘটবে।’ তিন বারই দেখা গেল আপনার আগমন হয়েছে। তখন থেকেই আমি সংকল্প করেছি, আপনার সাথে থেকে আপনার ‘আমল’ পর্যবেক্ষণ করব এবং সে মোতাবেক আমল করে আমিও জান্নাতী হব।
কিন্তু চাচা, আপনাকে তো বেশি কিছু আমল করতে দেখলাম না! তাহলে কী এমন বিষয়, যা আপনাকে নবীজীর পাক যবানে উচ্চারিত এই সৌভাগ্য এনে দিল?
সা‘দ রা. বললেন, (ভাতিজা!) আমার আমল তো ঐটুকুই যা তুমি দেখেছ!
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বোধ হয় কিছুটা আশাহত হলেন। ফিরে যাওয়ার সময় পেছন থেকে ডাক আসল- আবদুল্লাহ!
আবদুল্লাহ ফিরে তাকালেন।
হযরত সা‘দ বললেন, ভাতিজা, তুমি আমাকে যেমন দেখেছ আমার আমল তো ঐটুকুই। তবে একটি বিষয় আছে।
হযরত আবদুল্লাহ আগ্রহী হয়ে শুনতে লাগলেন। হযরত সা‘দ রা. বললেন, কোনো মুসলিম ভাইয়ের প্রতি আমি অন্তরে কোনো কটু চিন্তা পোষণ করি না, আর আল্লাহ কাউকে যে নিআমত দান করেছেন তার কারণে হিংসা করি না।
এ কথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ বলে উঠলেন, হাঁ, এই গুণটিই আপনাকে ঐ সৌভাগ্যের অধিকারী করেছে। আর এটিই আমরা পারি না।–মুসনাদে আহমাদ ৩/১৬৬, হাদীস ১২৬৯৭; কিতাবুয যুহদ, হাদীস : ৬৪৬
ক্ষমা বিষয়ে আল কুরআনে অনেক বর্ণনা এসেছে যেমন ‘আর যারা মানুষকে ক্ষমা করে আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন। ’
(সুরা : আল ইমরান, আয়াত : ১৩৪)
মানুষকে ক্ষমা করে দেওয়াটা তাকওয়ার পথকে মসৃণ করে। ক্ষমা তাকওয়ার নিকটবর্তী গুণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর ক্ষমা করে দেয়াই তাকওয়ার নিকটতম।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৩৭)
মহান আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। যে অন্যকে ক্ষমা করে তাকেও ভালোবাসেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা সুসময়ে ও দুঃসময়ে ব্যয় করে এবং ক্রোধ সম্বরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন। ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৪)
ক্ষমাকারীকে আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে পুরস্কার দেবেন। পরস্পরের মধ্যে বিরোধ নিষ্পন্নকারীও আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার পাবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর মন্দের প্রতিফল মন্দ। অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপস নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না। ’ (সুরা শুরা, আয়াত: ৪০)
আল্লাহ শুধু মানুষের বাইরের আমল দেখেন না, মনের অবস্থাটাও দেখেন। কার মনে অন্যের প্রতি হিংসা, কার মনে অন্যের ক্ষতি সাধনের চিন্তা তা আল্লাহ ভালো করেই জানেন। কাজেই আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে হলে বাইরের আমলের সাথে ভেতরটাকেও পবিত্র ও নির্মল করতে হবে। অন্যের সুখে ও সৌভাগ্যে আনন্দিত হতে হবে। অন্যের দুঃখে দুঃখী হতে হবে। তাহলেই আল্লাহ আমাদের উপর খুশি হবেন, আমরাও হতে পারব জান্নাতী মানুষ।
ফেসবুকে যে মেসেজটি ছড়িয়ে পড়েছিল তা শুধু মেসেজ হিসেবে গণ্য না করে উপরে বর্ণিত বিষয়গুলি মাথায় রেখে সত্যি সত্যিই ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা করার মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে আরও পরিশুদ্ধ করে নিতে পারি। নিজে ভালো থাকার পাশাপাশি অন্যরাও যেন ভালো থাকতে পারে তার জন্যও যতটা সম্ভব চেষ্টা করি। পবিত্র মাহে রমজান বিদায় নিতে চলেছে। আমরা জানিনা আমাদের কোন আমল আল্লাহ কবুল করেছেন কার কোন আমল কবুল করেননি। আল্লাহ আমাদের সব কাজে ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে কবুল করে নিন সেই প্রার্থনা করি এবং আসুন আমরা ক্ষমা চাই এবং ক্ষমা করে দিই।
পরিশেষে ক্ষমা বিষয়ে কিছু বিখ্যাত উক্তি সংযোজন করছি
১। একজন বিশ্বাসীর সবচেয়ে বড় গুণ হলো ক্ষমা করতে পারা।
— হাসান আল বসরী (রঃ)
২। সুন্দর বিদায় হলো ক্ষতি না করে বিদায় নেয়া, সুন্দর ক্ষমা হলো বকা না দিয়ে ক্ষমা করা, সুন্দর ধৈর্য হলো অভিযোগ না রেখে ধৈর্য্ধারণ করা।
— ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ)
৩। যদি তুমি সত্যি শিখতে চাও কিভাবে ভালোবাসতে হয় তবে অবশ্যই কিভাবে ক্ষমা করতে হয় তাও শিখে নিতে হবে।
— মাদার তেরেসা
৪। দুর্বলরা কখনোই ক্ষমা করতে পারে না। ক্ষমা শুধু শক্তিশালীরাই করতে পারে।
— মহাত্মা গান্ধী
৫। ক্ষমা ছাড়া কোনো ভালোবাসার অস্তিত্ব নেই এবং ভালোবাসা ছাড়াও ক্ষমার অস্তিত্ব নেই।
— ব্রায়ান্ট এইচ. এমসিগিল
৬। ক্ষমাই যদি করতে না পারো, তবে ভালবাসো কেন ?
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৭। ক্ষমা করে দাও কেননা আমাদের মাঝে কেউই ভুলের বাইরে নয়।
— সংগৃহীত
৮। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত। হৃদয়ের জন্য কোন সময়ের সীমা নেই, সে তার আপন সময়টুকুই নেয়… ভালোবাসতে, ক্ষমা করতে, ভুলে যেতে।
— তারিক রামাদান
১০। অন্যরা ক্ষমার যোগ্য এজন্য ক্ষমা নয় বরং নিজের মনের প্রশান্তির জন্য ক্ষমা।
— জোনাথন হুইয়ি
১১। ক্ষমা কখনো অতীতকে পরিবর্তন করতে পারে না তবে ভবিষ্যতকে আরো বড় করতে পারে।
— পল বোসে
১২। ক্ষমা হলো ভালোবাসার সবচেয়ে বড় রূপ যার প্রতিদান হিসাবে আপনি পাবেন হাজারো ভালোবাসা।
— রবার্ট মুলার
১৩। দুর্বল লোকেরা প্রতিশোধ নেয়,শক্তিশালীরা ক্ষমা করে দেয় এবং বুদ্ধিমানরা এড়িয়ে চলে।
— আলবার্ট আইনস্টাইন
১৬। ক্ষমা করো এবং ভুলে যাও দেখবে প্রতিশোধ এর আগুন কিংবা দুঃখ কোনোটাই থাকবে না।
— সংগৃহীত
১৭। সম্পর্ক তখনই মজবুত হয় যখন স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ই নিজেদের ভুলগুলোকে ক্ষমা করতে শেখে।
— সংগৃহীত
১৮। ক্ষমা মানে হলো অতীতে কি হয়েছে তা ভুলে যাওয়া এবং নতুন করে জীবন শুরু করা।
— জেরাল্ড জ্যাম্পোলস্কি
১৯। কেবলমাত্র ক্ষমাই পারে পাহাড় সম পরিমাণ একটি বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরি করতে।
— উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ড
২০। ক্ষমা ছাড়া জীবন হলো একটা জেলের মতো।
— উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ড
২১। তোমার প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই,ক্ষোভ নেই, কেবল আছে ভালোবাসা। তোমায় ক্ষমা করে দিলাম। আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা না থাকুক কোনো ক্ষোভ রেখো না, ক্ষমা করে দিও।
— জাজাফী