পিতার দায়

0
1688

৯ মে ২০২১

বারান্দার এক কোণায় পাটি পেতে বাহলুল সাহেব আর তার স্ত্রী তাদের ছোট ছেলেকে নিয়ে বসেছেন ইফতার সামনে নিয়ে। পবিত্র মাহে রমজান শেষ হতে চললো। গত বছর এই সময়ে ইফতারির সময় পরিবারে পাঁচজন সদস্য ছিলো। দু মাস হলো বড় মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। বড় ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ওর নাম আহনাফ আর ছোট ছেলেটা প্রাইমারি স্কুলে। এবার ক্লাস ফোরে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেটা দুপুরে বেরিয়ে গেছে বন্ধুদের সাথে ইফতার করবে বলে। ছোট ছেলেটা ইফতারির প্লেটটা সামনে নিয়ে উসখুস করছিলো।

বাহলুল সাহেব বুঝতে পারছিলেন ছেলের এই উসখুসের কারণ। ইফতারি তার পছন্দ হয়নি। প্লেটের এক কোণায় একমুঠো ছোলা মুড়ি আর দুটো খেজুর। গ্লাসে লেবুর শরবত। যেখানে চিনির বদলে গুড় দেওয়া হয়েছে। সারা দিন রোজা রেখে এই ইফতারি খাবে তা ছেলেটা কল্পনাই করতে পারে না।ছোট মানুষ তাই মনটা সহসাই খারাপ হয়। এর অবশ্য কারণও আছে। সে দেখেছে বাবা সকালেই এক গাদা বাজার করে এনেছে। সেখানে আম ছিলো, আনারস ছিলো,তরমুজ ছিলো, খেজুর ছিলো,আপেল এবং কমলাও ছিলো। আর এখন কিনা ইফতারির সময় সেসবের কিছুই তাকে দেওয়া হয়নি।মসজিদের মিনার থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। বাহলুল হাসেব প্লেট থেকে একটি খেজুর তুলে নিয়ে মুখে দিয়ে ইফতার শুরু করলেন। খেজুর খাওয়া শেষ হলে গ্লাস থেকে লেবুর শরবত পান করলেন।তিনি দেখলেন তার ছোট ছেলে আরহাম তখনো প্লেটে রাখা খেজুর দুটোকে এপাশ ওপাশ করছে।

বাহলুল সাহেব পেশায় স্কুল শিক্ষক। তার কোন ছাত্র কখনো বলতে পারবে না তিনি তাদের কাউকে বকা দিয়েছেন বা মেরেছেন। খুব্ই শান্ত স্বভাবের মানুষ। নরম দিল। পরিবারেও তিনি একই রকম। ছেলের এই অবস্থা দেখে তিনি বললেন আরহাম তুমি হয়তো ভাবছো সকালে যে এতো পদের ইফতার কিনলাম সেগুলো তোমাকে না দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আমরা খাবো আসলে কিন্ত তা নয়। সেগুলো তোমার বোনের শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়েছে। তুমিতো ছোট মানুষ তাই বুঝতে পারছো না। মেয়ে বিয়ে দিয়েছি এবারই প্রথম রমজান তাই অন্তত একদিন যদি ওর শ্বশুর বাড়িতে ইফতার না পাঠাই তাহলে তোমার বোনের কি সম্মান থাকবে বলো? চিন্তা করো না কয়েকদিন পর যখন ঈদের আগে বেতন পাবো তখন তোমার জন্য আবার ভালো ভালো আইটেম কিনে আনবো। তখন আমরা তিনজন একসাথে মিলে খাবো। বাবার কথায় ছোট্ট আরহামের মনটা শান্ত হলো। সে কপট অভিমানে বাবাকে বললো মনে থাকে যেন বাবা। সামান্য দুই আইটেমের ইফতার শেষ হতে তাদের খুব একটা সময় লাগলো না। বাড়ির কাছেই মসজিদ। ইফতার শেষ হতেই বাহলুল সাহেব মসজিদে চলে গেলেন। গিয়ে দেখলেন তখনো কোন কোন মুসল্লি ইফতার করছে। তাদের প্লেটের দিকে তাকালেই বুঝা যায় প্লেটে এখনো যা আছে তা বাহলুল সাহেবের ইফতারের শুরুর অংশের চেয়েও বেশি।তিনি সেসবের ভ্রুক্ষেপ না করে সামনের কাতারে গিয়ে বসলেন।

দক্ষিণ দিকে বসে ইফতার করছিলেন গোলাম রাব্বানী। তিনি বাহলুল সাহেবকে বললেন বাহলুল ভাই এতো দ্রুত মসজিদে চলে এসেছেন যে! ইফতারি করেছেন নাকি  করার সময় পান নি। আসেন আমার সাথে ইফতার করেন। বাহলুল সাহেব মুখে যথাসম্ভব হাসি টেনে বললেন নাহ ভাই ইফতার করেই এসেছি। ইফতারিতে আমি আসলে খুব বেশি খেতে পারিনা তাহলে নামাজের পর এই রাতে আর খাওয়া হয় না। কথাটা তিনি অবশ্য মিথ্যাও বলেন নি। সত্যি সত্যিই ইফতারিতে বেশি আইটেম খেলে তখন এই রাতে আর তিনি ভাত খেতে পারেন না।

ইফতার শেষে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে মুসল্লিরা দলে দলে মসজিদে এসে জমায়েত হলে নির্দিষ্ট সময়ে জামাত শুরু হলো। নামাজের মাঝেই বাহলুল সাহেবের মোবাইল দুবার বেজে উঠলো। সাইলেন্ট মুডে ছিলো বলে অন্য মুসল্লিদের অসুবিধা হয়নি। নামাজ শেষ হলে মসজিদ থেকে বেরিয়ে মোবাইলটা হাতে নিলেন। দেখলেন বড় মেয়ে ফোন করেছে। যেহেতু তিনি ধরতে পারেন নি তাই মিসড কল হিসেবে উঠে আছে। বাহলুল সাহেব মোবাইলের ব্যালেন্স চেক করলেন। দেখলেন পচিশ টাকা আছে। তিনি মেয়েকে ফোন করলেন। ওপাশ থেকে মেয়ে রুবানা ফোন ধরে বললো বাবা কেমন আছো? ফোন দিয়েছিলাম ধরলে না যে! বাহলুল সাহেব বললেন নামাজে ছিলামরে মা এই জন্য ধরতে পারিনি। মাত্র নামাজ শেষ করে ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম তুই ফোন করেছিলি তাই এখন ব্যাক করলাম। তোরা কেমন আছিস? বাবার কথায় রুবানার কন্ঠস্বর বদলে গেলো। বললো এই আছি মোটামুটি! মেয়ের কথা শুনে বাহলুল সাহেব জানতে চাইলেন এভাবে বলছিস কেনরে মা? জামাই,শ্বশুর শাশুড়ী সবাই ভালো আছে তো? আমরা যে ইফতার পাঠিয়েছিলাম  সেলিমের মাধ্যমে সেগুলো কি তোর শ্বশুর শাশুড়ির পছন্দ হয়নি? কিছু বলেছে তারা?

বাবার কথা শুনে রুবানা বললো বাবা শ্বশুর শাশুড়ি তেমন কিছু বলেনি তবে ফুফু শ্বাশুড়ি বলেছে ইফতারি একটু কম হয়ে গেছে! বাহলুল সাহেব মোবাইলে কথা বলতে বলতে পশ্চিম দিকে ফাকা মাঠের রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি মেয়েকে বললেন মারে সাধ্যমত চেষ্টা করেছি ইফতার পাঠাতে। ১৫ হাজার টাকার ইফতার পাঠিয়েছি। যাই হোক চিন্তা করিসনা বলবি বাবার শরীর খারাপ ছিলো তাই তেমন কিছু করতে পারেনি আগামী বার আরও বেশি করে পাঠাবে। বাবার কথা শুনে রুবানা বললো ঠিক আছে বাবা মনে থাকে যেন। আগামী বার কম পাঠালে আমার আর মান সম্মান কিছু থাকবে না। রুবানা দেখতে পায়নি মোবাইলের এ প্রান্তে বাহলুল সাহেবের চোখে পানি টলমল করছে। রুবানা একবারও জানতে চাইলো না বাবা তুমি যে বললে তোমার শরীর খারাপ কি হয়েছে তোমার? সে বরং তার শ্বশুরবাড়ির বিষয় নিয়েই বেশি উৎসাহী। বাহলুল সাহেব বললেন মারে অনেক ক্ষণ কথা হলো এবার রাখি? রুবানা বললো বাবা শোনো আরও কথা আছে!

বাহলুল সাহেব বললেন বল মা কি কথা বলবি। রুবানা বললো বাবা ঈদতো চলেই আসলো। তুমি তোমার জামাই এবং তার বাড়ির লোকদের জন্য ঈদের কাপড় দিবা না? নতুন নতুন এগুলো না দিলে কেমন লাগবে বলো? বাহলুল সাহেব কি আর বলবেন তিনি মেয়েকে বললেন হ্যারে মা কেন দেবো না অবশ্যই দেবো। রুবানা বললো কিন্তু বাবা বাড়ির লোকেরা বলছিলো তুমি যে কাপড় কিনবা তা অনেক সময় মাপ মত নাও হতে পারে আবার কালারও পছন্দ নাও হতে পারে। তার চেয়ে তুমি যদি টাকা দিয়ে দাও তাহলে ওরা সবাই কিনে নিতে পারবে। ওরা বলেছে ২৫ হাজার টাকা হলেই মোটামুটি হয়ে যাবে। তুমি বরং দু একদিনের মধ্যেই আহনাফকে দিয়ে টাকাটা পাঠিয়ে দিও। আর আহনাফ আসতে না পারলে বিকাশেও দিতে পারো। অবশ্য বিকাশে দিলে তুমি কিন্তু অবশ্যই খরচ সহ পাঠাবা। না হলে কিন্তু আবার বাজেটে কম পড়ে যাবে ক্যাশ আউট করতে গেলে। বাহলুল সাহেব নিজেকে শান্ত করে কোন মতে মেয়েকে বললেন ঠিক আছে চিন্তা করিস না। এই বলে তিনি ফোন রেখে দিলেন। অবশ্য ফোন রেখে না দিলেও এমনিতেই লাইন কেটে যেতো। ব্যালেন্স ছিলো পচিশ টাকা। তা দিয়ে তো আর ঘন্টা পার করা যায় না।

মেয়ের সাথে কথা বলা শেষ করে তিনি চোখ মুছে রাস্তার পাশেই বসে পড়লেন।সামান্য এক স্কুল মাস্টার তিনি। বেতন সর্বসাকুল্যে ১৮ হাজার টাকা। ছেলে মেয়েরা যখন ছোট ছিলো তখন সংসারের খরচ কিছুটা কম ছিলো। তাছাড়া তার স্ত্রী টুকটাক সেলাইয়ের  কাজ করেও কিছু টাকা আয় করতেন সেসব জমিয়ে তিন লাখ টাকা হয়েছিল। তার পুরোটাই মেয়ের বিয়েতে খরচ হয়ে গেছে। উপরন্তু আরও কিছু টাকা ধার দেনা করতে হয়েছে। বড় ছেলে আহনাফকে প্রতি মাসে থাকা খাওয়া বাবদ ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। আহনাফ দুটো টিউশনি করে বাকিটা সামলে নেয় কিন্তু সমস্যা হয় যখন সেমিস্টার ফি দেওয়ার  সময় আসে। হাতে যে টাকা ছিলো তা দিয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতার কিনে পাঠিয়েছে। বেতন পেতে এখনো কয়েকদিন বাকি। বোনাসও পাবে সামান্য। বেতন আর বোনাস মিলিয়ে হয়তো মোট টাকা পাবে ২৫ হাজার টাকা। অথচ রুবানা বলেছে তার শ্বশুরবাড়ির লোকদের কাপড় কিনতে লাগবে ২৫ হাজার টাকা। পুরোটা দিয়ে দিলে সংসার চলবে কি করে? বাড়িতে আরওতো চারজন মানুষ আছে।তিনি আর কিছু ভাবতে পারেন না! যে করেই হোক মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে টাকা পাঠাতেই হবে। না হলে রুবানার মানসম্মান থাকবে না। তিনি ভাবতে থাকেন কার কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া যেতে পারে! ধার নেওয়া কোন সমস্যা না কারণ তাকে সবাই খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে। যে কারো কাছে চাইলেই ধার পাবে কিন্তু সেটা শোধ করাটাই যত সমস্যা। তিনি ভাবতে ভাবতে বাড়ির  পথে হাটতে শুরু করলেন। অন্ধকার হয়ে গেছে। আকাশে তখন মস্ত বড় চাঁদ তার সাথে সাথে হাটছে। বাহলুল সাহেব ভাবছেন তার মেয়েটা বদলে গেছে! তার অসুস্থ্যতার কথা শুনেও একবার জানতে চায়নি কি হয়েছে বাবা তোমার? ডাক্তার দেখাওনি?

বাহলুল সাাহেব আর ভাবতে পারেন না। বেশি  ভাবলেই মনটা উথাল পাথাল করে ওঠে। এদিকে তারাবিহ নামাজের সময় হয়ে আসছে। তিনি দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে হাটতে শুরু করলেন। বাড়ি পৌছার পর স্ত্রী জানতে চাইলেন নামাজ পড়ে ফিরতে এতো দেরি হলো যে! বাহলুল সাহেব আসল কথা গোপন করে বললেন একটু হাটতে বেরিয়েছিলাম। তার  স্ত্রী তখন বললো তোমাকে আহনাফ বার বার খুজছিলো। কি যেন বলবে।তিনি ওজু করে ঘরে ঢুকলেন। বিছানার উপর বসলেন। কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকলো আহনাফ। বললো বাবা এসেছ? বাহলুল সাহেব তাকে কাছে ডাকলেন। বললেন তুই কি আমাকে কিছু বলবি? আহনাফ বাবার পাশে গিয়ে বসলো তার পর বললো বাবা ঈদের পর পরইতো আামার সেমিস্টার ফাইনাল। সব কিছু মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকা মত লাগবে। গত দুই মাসে টিউশনী থেকে যে টাকা পেয়েছিলাম তা থেকে খরচ করার পর দশ হাজার টাকা মত জমাতে পেরেছি। বাকি ২০ হাজার টাকা হলেই হবে। বাহলুল সাহেব বললেন চিন্তা করিসনা দেখছি কি করা যায়। তুমি খাবার খেয়ে শুয়ে পড়। আহনাফ বললো বাবা শুধু দেখি বললে কিন্তু হবে না। দেরি হলে কিন্তু এক্সাম দিতে পারবো না! তখন একটা সেমিস্টার পিছনে পড়ে যাবো। বাহলুল সাহেব ছেলেকে কি বলবেন তা বুঝে উঠতে পারলেন না। তিনি শুধু বললেন চিন্তা করিস না টাকার জোগাড় হয়ে যাবে।

বাবার সাথে কথা শেষ হলে আহনাফ বেরিয়ে গেলো। আরহামকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না দেখে বাহলুল সাহেব স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন আরহাম কোথায়? তিনি বললেন রান্না ঘরে আমার পাশে বসে আছে। বাহলুল সাহেব ছোট ছেলেকে ডাক দিলেন। বাবার ডাকে  আরহাম ঘরে গিয়ে বাবার পাশে বসলো। বাহলুল সাহেব জানতে চাইলেন তোমার কি এখনো মন খারাপ? ঈদতো চলেই আসছে তুমি ঈদে কী কী কিনতে চাও? আরহাম বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ তার পর বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো বাবা ঈদে আমার কিচ্ছু চাই না। গত বার যা কিনেছিলাম সবতো নতুনই আছে। ওগুলোতেই চলবে। বাহলুল সাহেবের চোখে আবার পানি চলে আসলো। তিনি বুঝতে পারলেন ইফতারের পর আরহামকে ওর মা খুব সুন্দর করে সব বুঝিয়েছে তাই সে ছোট হলেও বুঝতে পারছে।

তারাবিহ নামাজ শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে বাহলুল সাহেব যখন বিছানায় গেলেন তখন নানা চিন্তায় তার চোখে আর ঘুম আসলো না। তিনি ভাবতে লাগলেন কদিন বাদেই মৌসুমি ফলের সময়। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে নানা পড়ের ফল পাঠাতে হবে। কম পাঠালে মেয়ের সম্মান থাকবে না। এদিকে আবার দুমাস পর কোরবানির ঈদ। তখন হয়তো কোরবানীর জন্য একটা গরুও পাঠাতে হতে পারে। গরুর যে দাম তাতে ৫০ হাজার টাকার কমতো কোন ভাবেই কেনা সম্ভব না। এরচেয়ে কমে কেনা গরু পাঠালে মেয়ের মান সম্মান থাকবে না। তিনি বেঁচে থাকতে মেয়ের অসম্মান হোক তা হতে দিতে পারেন না। সব কিছুর জন্য চাই টাকা। কিন্তু তারতো সীমিত আয়। এ দিয়ে তিনি কি করবেন। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে সারাটা রাত পার করে দিলেন। সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে তিনি যখন ঘুমাতে গেলেন তখন ক্লান্তিতে দুচোখে ঘুম নেমে আসলো। ঘুমের মধ্যে কত রকম স্বপ্ন দেখলেন।

ঘুম থেকে যখন উঠলেন তখন বেলা সাড়ে নয়টা। তিনি হাত মুখ ধুয়ে খাতা কলম নিয়ে বসলেন হিসেব করতে। দেখতে চেষ্টা করলেন কোরবানীর ঈদ পযর্ন্ত তার কতটাকা দরকার। হিসেব করে যে পরিমান পেলেন তা ধার করা সম্ভব নয়। শেষে সিদ্ধান্ত নিলেন পশ্চিম মাঠে যে ধানের জমি আছে সেটা বিক্রি করে দিবেন নয়তো বন্দকি রাখবেন। অবশ্য বিক্রি করার চেয়ে বন্দকি রাখলে পরে সেটা টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়া যাবে। এর পরই তিনি বেরিয়ে পড়লেন বিভিন্ন জনের সাথে জমি বন্দকির বিষয়ে আলোচনা করতে। নিজেদের গ্রামে আলোচনা না করে পাশের গ্রামের পরিচিত কয়েকজনের সাথে কথা বললেন। পরে আবু সালেহ মাতব্বর সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে জমিটি বন্দকি নিলেন। বাহলুল সাহেব টাকা গুলো নিয়ে ব্যাংকে জমা রাখলেন।যখন যার জন্য যতটুকু দরকার তা তুলে খরচ করবেন। টাকা হাতে পাওয়ার পর আহনাফকে দিয়ে একটি খামে করে মেয়ের বাড়িতে টাকা পাঠালেন। ঈদের পর আহনাফ যখন ঢাকায় ফিরলো তখন তার সেমিস্টার ফির টাকাটাও দিয়ে দিলেন। বড় মেয়ে রুবানা টাকা পেয়ে যেমন খুশি হয়েছিল তেমনি আহনাফও খুশি। তারা অবশ্য দুজনের কেউ জানতে চেষ্টা করেনি বাবা কি করে এতোগুলো টাকা জোগাড় করলেন। আর বাহলুল সাহেব ভাবলেন যা কিছু করেছি সবতো ছেলে মেয়ের জন্যই। এই জমিজমা সবতো ছেলে মেয়ের জন্যই। ওদের জন্য খরচ না করলে কার জন্য রেখে দেবো।

ফসল তোলার সময় সেবার অর্ধেক ফসল বাড়িতে আসলে বাহলুল সাহেবের স্ত্রী জানতে চাইলেন ফসল অর্ধেক এসেছে কেন? তিনি তখন ঘুরিয়ে বললেন এবার জমি নিজে চাষ করতে পারিনি,বর্গা দিয়েছিলাম  তাই অর্ধেক এসেছে।তিনি চিন্তা করতে লাগলেন এবারতো অর্ধেক এসেছে পরের বার যখন একটুও আসবে না তখন কী জবাব দিবেন? মনে মনে ঠিক করে রাখলেন তখন বলবেন ফসল বাড়িতে আনার ঝামেলা তাই বর্গা চাষীকে বলেছি বিক্রি করে টাকা দিতে সেই টাকা দিয়ে চাল ডাল কিনে খাবো। আবার ভাবলেন যা সত্যি তাই না হয় স্ত্রীকে বলে দেই। পরিবারের দুঃখ ব্যথা দুজনে শেয়ার করেই চলা উচিৎ। একরাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি স্ত্রীকে পিতা হিসেবে তার দায় নিয়ে সব খুলে বললেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন নি যে তার কোন কথাই তার স্ত্রী শুনতে পায়নি। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে তার দুচোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছিল। ( পরিমার্জন করতে হবে)