আমার কিছু ইচ্ছের কথা বলি। ইচ্ছেগুলো সত্যি হোক বা না হোক বলতে তো দোষ নেই। হতেও পারে আমার এই ইচ্ছের কথা অন্য কারো ইচ্ছের সাথে মিলে গেছে। আর তার পর হয়তো নতুন কিছু হতে পারে। আমার বাসা যেহেতু কক্সবাজারে তাই আমি কক্সবাজার কেন্দ্রীক দু একটি কথা বলতে চাই। কক্সবাজারে সমিতিপাড়া নামে একটি এলাকা আছে। এয়ারপোর্টের পশ্চিম সাইডে সমুদ্র সৈকতের পাশ ঘেষা এরিয়া। এখানে যারা বসবাস করে তাদের ৯৯ শতাংশই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। দিন আনে দিন খায়। এর একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে বাকি কথাগুলো লিখতে চেষ্টা করছি।
বেশ কিছুদিন আগে কাজের প্রয়োজনে আমি ওই এলাকায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। এমনকি ওখানে সমুদ্রে নেমে গোসল করেছিলাম। আমি সাধারণত সমুদ্র খুব ভালোবাসি এবং আমার ব্যাগে সব সময় অন্তত একটি টাওয়েল থাকে আর পরণে একাধিক শর্টপ্যান্ট থাকে যেন আমি ইচ্ছে হলেই সাগরে নামতে পারি। তো সেদিনের স্মৃতিটা আমার আজও মনে আছে। আমি সাগরে নেমে সাতার কেটে কাপড় বদলে যখন মূল রাস্তার দিকে হাটছি তখন দেখলাম দুটি ছেলে ছোট ছোট ঝাউগাছের উপর তাদের ভেজা হাফ প্যান্ট শুকাতে দিয়ে গায়ের জামা কোমরে পেচিয়ে অপেক্ষা করছে। কাছে গিয়ে বললাম তোমরা এভাবে দাড়িয়ে আছো কেন? কাপড় শুকানো হলে তার পর বাড়িতে যাবা? ওরা বললো হ্যা কাপড় শুকানোর পর বাড়ি যাবে।
তার পর যে কথাটা বললো সেটি বেদনাদায়ক। আমি বললাম ভেজা কাপড়ে বাড়িতে গেলে কি মা বকা দিবে? তখন ওরা বললো মা বকা দিবে না । তখন জানতে চাইলাম তাহলে এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো? বাড়িতে গিয়েইতো কাপড় শুকাতে দিতে পারো। ওরা তখন বললো ওদের দুজনেরই ওই একটা করে প্যান্ট তাই শুকিয়ে তার পর সেটা পরতে হবে। এখানে ভালো রোদ আছে দ্রুত শুকাবে। আমার খুব খারাপ লাগলো। আমি যে হাফপ্যান্ট পরে সাগরে নেমেছিলাম সেটি ওদের একজনকে দিয়ে দিলাম। যদিও তার একটু লুজ হবে তাও সে বললো ম্যানেজ করতে পারবে। ওটা পেয়ে সে ভীষণ খুশি হলো। অন্যজনকে বললাম আবার যেদিন আসবো তোমার জন্যও একটা নিয়ে আসবো। তার পর সত্যি সত্যি বেশ কিছুদিন পর আবার যখন গেলাম তার জন্যও একটা প্যান্ট নিয়ে গিয়েছিলাম। সে সেটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল।
উপরের এই ঘটনাটা বলে আমি নিজের মহত্বের প্রচার করছি না। প্রসঙ্গক্রমে ঘটনাটি বলতে হলো। আমাদের একাধিক মাননীয় মন্ত্রী তাদের নানা বক্তব্যে বলেছেন দেশে গরীব মানুষ নাই। মানুষের অনেক টাকা হয়েছে,ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। তারা চাইলে তিন বেলা মাংস খেতে পারে। এক শ্রেণীর মানুষের টাকা হয়েছে এ কথা আমিও স্বীকার করি। কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ গরীব হতে হতে পথে বসে গেছে। এই যে সমিতিপাড়ার কথা বললাম ওখানেই একদিন সন্ধ্যায় দেখলাম ভ্যানে করে কাপড় বিক্রি হচ্ছে প্রতিটা ২০ টাকা দাম। তাও দেখলাম কেউ কেউ কেনার ক্ষমতা রাখে না। এই পুরো এলাকায় প্রায় ৩০০ ছোট ছোট ছেলে মেয়ে আছে। তাদের প্রত্যেকের অবস্থাই এমন। তারা দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। আমার একার পক্ষে এদের সবাইকে কিছু দেওয়া সম্ভব হয় না দেখে আমি দু একবার ুওদের কিছু সংখ্যককে ৫ টাকা দশ টাকা দামের আইসক্রিম খাইয়েছি। ওদেরকে কাপড় দেওয়া না দেওয়া নিয়ে মূলত আমার এই লেখা নয় বরং এবার আসি মূল ঘটনায়।
কিছুদিন আগে কাজের প্রয়োজনে আবারও সমিতিপাড়ায় গিয়েছিলাম। সমিতিপাড়াতে ঢুকতে সাগরের দিকে দ্বিতীয় যে গলিটা ওটা দিয়ে আমি সাগরের দিকে হাটলাম। ভাবলাম ওদিকটায় একটু হাটাহাটি করে তবেই ফিরবো। সাগরের কাছাকাছি যাওয়ার পর পেটে টান পড়লো। ইমার্জেন্সি টয়লেটে যাওয়ার দরকার হলো। আসেপাশে যে বাড়িগুলো দেখলাম সেখানে টয়লেট চোখে পড়লো না। একটি পিছিয়ে আসতেই ওখানে একটা বাংলো দেখা যায়। শুনেছি কোনো এক পুলিশ কর্মকর্তার বাংলো। গেট লাগানো থাকে তাই ভিতরে কি আছে না আছে জানা নেই। তার পরেই যে বাড়িটা একটা খুপরি ঘরের মত। উঠোনে একটা টিউবওয়েল আছে। সেখানে একটা বাচ্চা খেলা করছে এবং তার পাশে এক ভদ্রমহিলা কিছু শাক সবজি কাটাকাটি করছে। আমি তাকে বললাম আপনাদের বাড়িতে টয়লেট আছে? আমার জরুরী যাওয়া দরকার। তিনি তাদের টয়লেট দেখিয়ে দিলেন। আমি টিউবওয়েল থেকে বদনায় করে পানি নিয়ে টয়লেটে গেলাম। ওখানে যাওয়ার পর আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো বিশ বছর আগে আমাদের বাড়ির দৃশ্য। ঠিক এমনই টয়লেট ছিলো আমাদের। তিনপাশে পলিথিন মোড়ানো, দরজা নেই। দরজার একটা বেশ বড় অংশ পুরোপুরি ফাঁকা। কেউ হঠাৎ করে আসলে যে টয়লেটে আছে সে লজ্জা পাবে আর যে আসবে সেও লজ্জা পাবে। এই টয়লেটই ছেলে মেয়ে সবাই ব্যবহার করে। টয়লেট থেকে বেরিয়ে টিউবওয়েলের পানিতে হাত ধুতে ধুতে সেই ভদ্রমহিলার কাছে জানতে চাইলাম এই টয়লেট যদি টিন দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় তাহলে কত খরচ হবে? তিনি জানালেন পাঁচ ছয় হাজার টাকা খরচ হবে। আর যদি নিচের অংশ ইটের গাথুনি দেওয়া হয় তবে সেটা কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা লাগবে। তাদের থাকার ঘর দেখেই বুঝেছি টয়লেটের জন্য ৫ হাজার কিংবা ১৫ হাজার খরচ করা তাদের পক্ষে কোনো কালেও সম্ভব নয়। এই দৃশ্য শুধু ওই একটি বাড়িতেই এমন নয়। আশেপাশে প্রায় সব বাড়িতে। নিচে কোনো মত একটা স্ল্যাব দিয়ে রাখা। উপরে খোলা,দরজাবিহীন চটের বস্তায় ঘেরা টয়লেট। অনেক বাড়িতে আবার টয়লেটও নেই। তারা পাশেই ঝাউবাগানের উপরই নির্ভর করে।
এই সব দৃশ্য গভীর ভাবে দেখলে খুবই সামান্য ব্যাপার মনে হবে। কারণ ঠিকমত তিন বেলা অনেকে খেতেই পায় না,পরার মত কাপড়ই পায় না সেখানে পাকা করা কিংবা টিন দিয়ে ঘেরা টয়লেটের স্বপ্ন দেখাতো অনেক দূরের ব্যাপার। এই এলকারা জনপ্রতিনিধিরা এদিকে কখনো আসেও না। উল্লেখ্য প্রায় প্রতিটি বাড়িতে অবশ্য একটা করে টিউবওয়েল দেওয়া আছে। যদিও সেই টিউবওয়েলে সব সময় পানি ওঠে না। জনপ্রতিনিধিরা থাকে ধরাছোয়ার বাইরে। তারা এখন উন্নয়ন প্রচারে ব্যস্ত। কিংবা তারা আরও বড় বড় সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত। এই সব ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?
আমার মনে হয় প্রতিটি বাড়িতে টয়লেট থাকাটা জরুরী। এবং সেই টয়লেটে দরজা থাকাও জরুরী। আমার আর্থিক সক্ষমতা থাকলে নিশ্চই এই এলাকার প্রতিটি বাড়িতে একটি করে অথবা কয়েক বাড়ির জন্য একই স্থানে কয়েকটি যৌথ টয়লেট বানিয়ে দিতাম। এমন যৌথ টয়লেট বানাতে হলেও অন্তত ৩০ টা টয়লেট বানানো লাগবে। অনেক খরচের ব্যাপার। আপনাদের এ বিষয়ে মতামত কী? এই মানুষগুলোকে কি আমরা সবাই মিলে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট বানিয়ে দিতে পারি? পাকা করা না হোক অন্তত চারপাশে টিনের বেড়া আর সামনে টিনের দরজা বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে? যার প্রতিটিতে খরচ হবে ৫/৬ হাজার টাকা। কিংবা আপনাদের কারো পরিচিত এমন কোনো সংস্থা আছে যারা এ বিষয়ে হেল্প করতে পারবে। আমার খুবই ইচ্ছে এই দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা শিশু কিশোর কিশোরীদের জন্য কিছু করার এবং এই এলাকার মেয়েরা যেন অন্তত দরজা যুক্ত টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ পায় সে বিষয়ে কিছু করা। এই বিষয়ে আপনাদের পরামর্শ চাই। কিভাবে এটি করা সম্ভব হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? এই বিষয়ে আপনিকি কোনো ভাবে এগিয়ে আসতে পারবেন? কক্সবাজারে আমার পরিচিত কিছু মানুষ আছে তাদের মাধ্যমে এটি করা সম্ভব হবে যদি আর্থিক বা র ম্যাটেরিয়ালের যোগান পাওয়া যায়।
— জাজাফী
১৩ জুন ২০২২