জাজাফী

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের জন্ম হয়নি তাই ইতিহাস থেকে জেনেছি আমাদের পুর্বসুরীদের আত্মদানের কথা। তাদের জীবনের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এসেছিল তার সুফল আমরা ভোগ করছি।এই প্রজন্মের প্রতিটি কিশোর-কিশোরী,তরুণ-তরুণীর মনের মধ্যে গেঁথে ছিলো স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কথা। সবাই ভেবেছিল এই দিনে গোটা বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে আনন্দের বান ডেকে যাবে। কথা ছিলো রাজধানী ঢাকা সহ দেশের প্রতিটি শহরে,মহল্লায় লাল-সবুজের ঢল নামবে। তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী সবার গায়ে থাকবে লাল-সবুজের পোশাক,হাতে থাকবে ছোট্ট একটি লাল সবুজের পতাকা, আর মাথায় থাকবে ফেস্টুন।

কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। কিংবা বলা যায় আমাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। আমাদের এই স্বপ্ন ভাঙ্গার দায় কার? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ছেলে বুড়ো সবার যখন আনন্দ মিছিলে বেরিয়ে আসার কথা তখন সবাই আমরা অবরুদ্ধ। দীর্ঘদিন আমরা অবরুদ্ধ ছিলাম করোনা ভাইরাসের কারণে তবে এবার আমরা অবরুদ্ধ অন্যভাবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী হয়ে উঠেছে দলীয় উঁৎসব। এমন একটি উদযাপনের সুযোগ পেলোনা আপামর জনসাধারণ। বিগত দিনগুলোতে আমরা দেখেছি যে দলই ক্ষমতায় বসেছে জাতীয় দিবসগুলো হয়ে উঠেছে কেবল মাত্র তাদের নিজস্ব উদযাপনের দিন। ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলো যেমন মনে করেছে এই দেশে জাতীয় দিবস বলে আসলে কোন দিন নেই। আমরাতো এমন বাংলাদেশ চাইনি। মুখে যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলে তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে আপনারা কি বলতে পারবেন বঙ্গবন্ধু আসলে কোন আদর্শ রেখে গেছেন যা আপনারা ধরে রেখেছেন?

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবার কথা ছিলো দল মত নির্বিশেষে একত্র হয়ে। প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানে কেবল মাত্র রাষ্ট্রীয় অতিথি এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ ছাড়া আর কেউ যেতে পারেনি। বিরোধী দল গুলো ছিলো একেবারেই নিস্ক্রিয়। চোখে পড়ার মত তাদের কোন কর্মসুচী ছিলো না এই ঐতিহাসিক দিনে।তাদের কি এই দিনের জন্য কোন বাজেট ছিলো না? দেশ প্রেমের জন্য বাজেট লাগে? অন্যদিকে সরকার এ ক্ষেত্রে কোন ভূমিকাই পালন করতে পারেনি। সরকারের উচিত ছিলো সব কিছু ভুলে গিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই আয়োজনকে সর্বদলীয় করে তোলা। যেখানে আওয়ামীলীগ,জাতীয় পার্টি,বিএনপি সহ অন্যান্য স্বাধীনতার স্বপক্ষের দলগুলোকে একত্র করে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়ে একটি সুন্দর আয়োজন করা যা দেখে বিশ্ববাসী অবাক হয়ে যাবে।কিন্তু আমরা তা দেখিনি। এমনকি এই দিনে বেগম জিয়ার কোন বক্তব্যও চোখে পড়েনি। হয়তো আমার চোখে পড়েনি কিন্তু অন্যদের চোখে পড়েছে বলেও শুনিনি।

এই আওয়ামীলীগ অনেক বদলে গেছে। তারা মনে ও মননে আমুল পাল্টে গেছে। মনে পড়ে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর সময়েও ক্ষমতায় ছিলো এই আওয়ামীলীগ। তখন সেই আয়োজনে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা,ইয়াসির আরাফাতের মত বিশ্ব বরেণ্য নেতা। যাদের গ্রহণযোগ্যতা সর্বত্র। এবারও বিশ্ব বরেণ্য অনেকেই এসেছেন তাদের নিয়ে কোথাও কোন অসুবিধা নেই। মূল সমস্যা গিয়ে দাড়িয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে।বাংলাদেশ সরকার ভালো করেই জানে বাংলাদেশের মুসলিমরা আবেগপ্রবন এবং ধর্মীয় বিষয়ে তারা কোন ভাবেই ছাড় দিতে রাজি নয়। ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদির চেয়ে বরং নরেন্দ্র মোদির নানা সময়ে ধর্ম বিষয়ে আপত্তিকর অবস্থানই মূলত বাঙ্গালীদের মধ্যে মোদি বিরোধীতার জন্ম দিয়েছে। কাশ্মীর ইস্যু থেকে শুরু করে সম্প্রতি ভারতের আদালতে একজন আপিল করেছে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের 26টি আয়াত বাতিলের সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তা এখনো ঝুলিয়ে রেখেছে অথচ এটি খারিজ করে দেওয়ার কথা ছিলো। এমনকি নরেন্দ্র মোদি এ বিষয়ে নিরবতার ভূমিকা পালন করে একার্থে ওই লোকের আবেদনকেই সমর্থন করেছে যা বাঙ্গালী মুসলিমদের মনে মোদি বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছে। যারা প্রতিবাদ করেছে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর বিরোধীতা করে তারা কি ভুল করেছে প্রতিবাদ করে? তাদের কি এই অধিকার নেই? দেশটা কি তাদের কারো নয়?

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দেশের অনেক যায়গায় বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। সবটাই হয়েছে মোদির বাংলাদেশ সফর ঘিরে। যখন সংবাদে জানানো হলো স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসবেন তখন থেকেই সরব ছিলো অগণিত বাঙ্গালী। এসব খবর জানার পরও সরকার নরেন্দ্র মোদি বিষয়ে সিদ্ধন্তে স্থির থাকার মাধ্যমে এদেশের জনগণের মতামতকে আরও একবার পদদলিত করেছে।শুধু তাই নয় বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম ফেসবুক ও মেসেঞ্জারকেও তারা নিয়ন্ত্রণ করেছে। ফলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ঘরে বসে বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে কাটানোর ক্ষেত্রেও আমরা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। সাংবাদিকদের কাছে অনেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুললে তারা সরকারের নেতৃস্থানীয়দের সাথে কথা বলেছে কিন্তু তারা তাদের শেখানো কথাই উত্তর হিসেবে সাংবাদিকদের বলে দিয়েছে যে, না তারা ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। এর ঠিক একদিন পর ফেসবুক কর্তৃপক্ষ নিজ থেকেই জানিয়েছে যে তাদের সহযোগিতা ছাড়াই বাংলাদেশ সরকার ফেসবুক নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এই প্রযুক্তি বাংলাদেশ সরকারের হাতেই আছে।

এই যে একটি বক্তব্য সারা দেশের  মানুষের কাছে মিথ্যা বলে প্রমানিত হলো  এতে সরকারের ভাবমুর্তি নষ্ট হয় না? এর আগে টিকা ইস্যুতে একটি দেশের নাম উল্লেখ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলেছিলেন অমুক দেশ আমাদের থেকে টিকা নিতে চেয়েছে  এই বক্তব্যের বিপরীতে সেই দেশ জানালো তারা আমাদের কাছে কোন টিকা চায় নি! মিথ্যা কোন না কোন ভাবে এক সময় ঠিকই আলোতে চলে আসে।তখন মানুষ সেটা জানতে পারে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর যে উৎসবের স্বপ্ন আমরা দেখতাম তার কিয়দাংশও পুরণ হয়নি উপরন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ব্যক্তি স্বাধীনতার পায়ে শেকল পরানো হয়েছে। সরকার একদিকে বলছে তারা কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে না,বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে না, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে প্রকারান্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে কিছু বলে দেখো বুঝবে কত ধানে কত চাল।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকা সহ সারা দেশে যত জায়গায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার দায় ক্ষমতাসীনদের উপরও অনেকটা বর্তায় এবং এটি এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। যারা আন্দোলন করেছে তারা আগে থেকেই জানিয়েছে তারা ভারত বিরোধী নয় বরং তাদের একমাত্র সমস্যা নরেন্দ্র মোদি।এটা জানার পর সরকার চাইলেই সাম্ভাব্য পরিস্থিতি কী হতে পারে সেটা বিবেচনা করে এই অনুষ্ঠানকে আরও সফল করতে পারতো। এই যে একাধিক প্রাণ গেলো,জ্বালাও পোড়াও হলো,হরতালের ডাক আসলো এর কোনটিই তখন ঘটতো না।স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান আমরা কেউ কোন কালেও অস্বীকার করি না এবং কোন ভাবেই ছোট চোখে দেখি না। ভারতের সহযোগিতা ছিলো বলেই আমরা স্বাধীনতা অর্জনের পথটাকে আরও মসৃন করতে পেরেছিলাম। তা না হলে হয়তো আমাদের আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হতো। ভারতের সাথে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক এবং সেটা আজীবন অটুট থাকুক এটাও সবাই চায় কিন্তু এক নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো না জানানো নিয়েতো  সেই সম্পর্ক চিড় ধরতো না। অথচ তা করতে পারলে এই দিনে এমন করে রক্ত ঝরতো না,কলঙ্কিত হতো না স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।

মনে রাখা দরকার ছিলো স্বাধীনতা যেমন কোন এক পক্ষের একক অবদানে অর্জিত হয়নি, তেমনি এই দেশটিও একক কোন দলের নয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সেদিন দল মত নির্বিশেষে আপামর বাঙ্গালী স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল।সেই অনেক ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান প্রশ্নবিদ্ধ হলো কিছু মানুষের রক্ত ঝরিয়ে,সম্পদের ক্ষতি করে। যারা মিছিল করেছিল তাদের দোষ ছিলো তারা লাঠি হাতে মিছিলে নেমেছিল, তাদের চোখে মুখে ছিলো প্রতিহিংসা। কিন্তু তারাতো মারমুখী হয়ে ওঠেনি যতক্ষণ না পুলিশ তাদের সামনে বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে,দিকে দিকে ছাত্রলীগের ছেলে মেয়েরা বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে। তখনই সংঘর্ষের ঘটনার জন্ম হয়েছে। সুতরাং দোষ থাকলে উভয় পক্ষেরই দোষ দিতে হবে।

স্বাধীন একটি দেশে যে কোন ঘটনার প্রতিবাদে যে কেউ মিছিল করতেই পারে। ন্যায্য দাবী হলে সেটি শোনাও একটি সুশীল সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু সরকার যখন বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, তখন তাদের কাছে কোন দাবীয় আর ন্যায্য থাকে না। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান একত্রে করাও যুক্তিযুক্ত হয়নি। কেননা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সব মানুষের মনে দাগ কাটার কথা যেটা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে কাটবে না। যারা বিএনপি করে বা অন্যান্য দল করে তাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর জন্ম উৎসবের চেয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব অনেক বেশি আগ্রহের। কিন্তু একই সাথে দুটোর আয়াজন করার মাধ্যমে প্রকারান্তে সরকার জেনে শুনে বাকি দলগুলোকে এই আয়োজনে আগ্রহী হতে নিরুৎসাহীত করেছে বলে আমি মনে করি। চারদিকে এতো উন্নয়নের মধ্যে এমন মনোভাব সত্যিই পীড়াদায়ক। এভাবে চলতে থাকলে বাহ্যিক দিক থেকে হয়তো আমরা উন্নত একটি দেশ নির্মানে সক্ষম হবো তবে আমাদের মধ্যে ভ্রাতিত্বের কোন বন্ধন থাকবে না। পারস্পারিক সহযোগিতার মনোভাব থাকবে না। একটি দেশকে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যেতে হলে ছোট বড় সব শ্রেণী পেশা ও মতবাদের মানুষকে এক সাথে মিলে মিশে কাজ করতে হয়। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব দেখে সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে।আমাদের স্বপ্ন ভঙ্গের দায় তাহলে কার?

28 মার্চ 2021

প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী

[email protected]

www.zazafee.com