বই মেলা আমার খুবই প্রিয়।ছোটবেলা থেকে বই পড়ার যে নেশা তৈরি হয়েছিল তা আরও বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল বইমেলার কারণে।আমার সারাদিন কাটতো টিএসসিকে ঘিরে।তাই প্রতিবছর বইমেলা শুরু হলে প্রায় রোজই মেলায় ঘুরে বেড়াতাম।এই মেলা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে,অনেক আনন্দ দিয়েছে। 2006 সাল থেকে 2019 সাল পযর্ন্ত প্রতিটি বইমেলায় আবার ছিলো অবাধ বিচরণ। কিন্তু এবারই ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটলো। বইমেলার শুরুর কিছুদিন আগেই কক্সবাজার চলে যেতে হলো।ভেবেছিলাম বইমেলার মাঝে একদিন ঘুরে যাবো কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। দিনের পর দিন পার হতে লাগলো।ঢাকার যানজট,বিরক্তিকর শব্দ সবই কেন যেন ভালোই লাগতো। সপ্তাহে দুদিন সবার সাথে আড্ডা দিতাম।কিন্তু সব থেমে গেলো। তার পর করোনা ভাইরাসের লকডাউনে কেটে গেলো অনেকগুলো দিন,সপ্তাহ,মাস। অবশেষে তিনদিনের ঝটিকা সফরে ঢাকায় ফিরলাম।
22 জুলাই রাতের গাড়িতে ঢাকায় রওনা দিলাম।উদ্দেশ্য আমার ঢাকার বাসা বদলাতে হবে।দীর্ঘদিন না থাকার পরও আমি নিয়মিত বাসা ভাড়া পরিশোধ করেছি। ওখানে আমার প্রিয় কম্পিউটার,তিনশো মত বই,প্রচুর ম্যাগাজিন সহ অন্যান্য অনেক গুরুত্বপুর্ন দ্রব্যাদি ছিলো।সব সরিয়ে নিতে হবে। আমি যে বাসায় ভাড়া থাকতাম সেই বাড়ির মালিক মারা যাওয়ার পর তার সন্তানেরা বাড়ির দখল নিতে শুরু করে এবং আমি যে ফ্ল্যাটে ছিলাম সেটা্ও একজন দখল নিয়েছে। তারা নোটিশ দিলো ঈদের আগেই বাসা ছেড়ে দিতে হবে।আমি যেহেতু ঢাকার বাইরে আছি তাই বাকবিতন্ডায় না গিয়ে বাসার সব কিছু শিফট করার চিন্তা করলাম। আমার হাতে সময় খুবই কম। মাত্র তিনদিনে আমাকে অনেক কিছু করতে হবে তাই বসে বসে কর্মপরিকল্পনা করে তার পর ঢাকায় ফিরলাম।
আমি যখন গাড়ি থেকে নামলাম তখন সকাল সাড়ে সাতটা বাজে।ছয় মাস আগে ঢাকাকে আমি যেমন দেখে গিয়েছিলাম ছয় মাস পরেও ঠিক তেমনই আছে বলে মনে হলো! আমাদের উন্নয়ন কতটা গতিসম্পন্ন তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। বাসায় গিয়ে রুমে ঢুকেই ধাক্কা খেলাম। মনে হলো আমি কোন প্রাগৈতিহাসিক গুহায় এসে পৌছেছি।ক্যাপ্টেন নিমো মারা যাবার বহু বছর পর তার বিখ্যাত ডুবো জাহাজ নটিলাস খুজেঁ পাওয়ার পর যেমন দেখাচ্ছিল আমার রুমটা যেন ঠিক তেমন হয়ে গেছে। সবকিছু আগের জায়গাতে থাকলেও তার উপর কয়েক স্তর ধুলো ময়লা জমে একাকার অবস্থা। ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রেখে প্রথমে বইগুলো সরিয়ে পরিস্কার করলাম। টেবিল পরিস্কার করলাম এবং এর মাঝে কম্পিউটার চালু করতে চেষ্টা করে আবার ধাক্কা খেলাম। পরিকল্পনার একটা অংশ এমন ছিলো যে কম্পিউটারের সব ডেটা কপি করে আমার পোর্টেবল হার্ডডিস্কে নিবো এবং কম্পিউটার থেকে সব মুছে ফেলে সেটা গ্রামে পাঠিয়ে দেবো। সেখানে আমার ভাইয়ের একটা মেয়ে আছে সে কম্পিউটার চালাতে পারবে।কিন্তু দীর্ঘদিন চালু না করার কারণে ধুলোর আস্তর জমে কম্পিউটার অকেজ হয়ে গেছে। খুব বেশি চেষ্টা করার সুযোগ আমার হাতে ছিলো না তাই আর চেষ্টা না করে অন্য কাজে মনোযোগ দিলাম।
পুর্ব পরিকল্পনা মাফিক বইগুলোর একটা তালিকা করলাম। বই কোথায় কতগুলো রাখবো তা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম সে অনুযায়ি তালিকা করে ফেললাম। তালিকা বলতে বইয়ের নাম এবং লেখকের নাম লিপিবদ্ধ করলাম। কম্পিউটার চালু হলে তা সরাসরি টাইপ করা হতো কিন্তু যেহেতু সেটা করা যায়নি তাই কাগজে লিখলাম। বইয়ের লিস্ট করা হয়ে গেলে সেগুলো আলাদা করে বেশ কিছু কার্টুনে ভরলাম। কিছু বই কোথাও রাখার মত অবস্থা ছিলো না বলে কেজি দরে বিক্রি করে দিলাম। বাসা বদলাতে না হলে ওই বইগুলি বিক্রি করতে হতো না। 38 কেজি বই বিক্রি করে দিয়েছি।লিস্ট অনুযায়ি ইস্টার্ন ব্যাংক উত্তরা শাখাতে যাওয়ার কথা আমার একটি পেমেন্ট সেটেলমেন্ট করার জন্য। হাতের কাজ খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে ব্যাংকে গেলাম। কক্সবাজার ব্রাঞ্চে আগেই বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করেছিলাম কিন্তু বিশ দিনেও তা কার্যকর হয়নি বলে উত্তরা ব্রাঞ্চে যাওয়া। তারাও খানিকটা সময় বসিয়ে রেখে সেই একই কথা বললেন এবং আবার একটা ফর্ম ধরিয়ে দিলেন পুরণ করার জন্য। পুরণ করা শেষ হলে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে গেলাম সিটি ব্যাংকে। আমার একটা আমেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ড রিনিউ করার জন্য।ওখানে কাজ শেষ করে দ্রুত বাসায় ফিরে গেলাম। সারাদিন কাজ করে রাতে মনে হলো কাজের মূলত সব বাকি। খুবই ঘাবড়ে গেলাম। শেষে পরদিন শুক্রবার সকালে উঠে কোন কিছু না ভেবেই যা আছে সব প্যাক করা শুরু করলাম। ভাবলাম সময় মত সব প্যাক করে যেটা যেখানে পাঠানোর সেটা সেখানে পাঠিয়ে দেই। তার পর কখনো না হয় সব ঠিক করে নেওয়া যাবে। যে ভাবনা সেই কাজ। আর এটা করতে গিয়ে কাজ মূলত অনেকটাই এগিয়ে গেলো। কিন্তু যে পরিমান কার্টুন হচ্ছে তাতে আমার পক্ষে কুরিয়ারে নেওয়া সম্ভব নয় তখন পরিচিত এক ভাইকে ডাকলাম। সে বলার সাথে সাথেই চলে আসলো। তার বাসা বাড্ডাতে। এদিকে বইগুলোর কিছু অংশ বাড্ডাতে তুর্যদের বাসায় রাখার কথা। যেহেতু ওই ভাইয়ের বাসা ওদিকে তাই সে আসলে একই সাথে অনেক কিছুই করা যাবে ভেবে তাকে ডাকলাম। সে আশার পর বাকি কাজ গুছিয়ে একটা ভ্যান ঠিক করে সব নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সুন্দরবন কুরিয়ারে বুকিং শেষ করে প্রথমে গেলাম একটা সুপারশপে। সেখান থেকে 989 টাকার চকলেট কিনলাম তুর্য আর তুর্ণর জন্য। চকলেট কিনে একটা আমি নিজে খেলাম আরেকটা ওই ভাইকে দিলাম। এর পর চকলেটের প্যাকেট ওনার হাতে দিয়ে ওনাকে সিএনজিতে উঠিয়ে দিয়ে বিদায় জানালাম।দুঃখের ব্যাপার হলো ওই ভাই চকলেটগুলো ভুলে সিএনজিতে ফেলেই নেমে গেছে। শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। বেছে বেছে এত্তো রকম চকলেট কিনেছিলাম।আমি তখন পরিচিত দুই ভাইয়ের সাথে রাজলক্ষ্মীতে গল্প করছিলাম এসব নিয়ে। পরে সেদিনই রাতে আবার চকলেট কিনলাম এবং বাসায় নিয়ে গেলাম। আর সেই ভাইকে বলে রাখলাম পরদিন শনিবার যেন চকলেটগুলো দিয়ে আসে।
সখ,তাসিন তাজিম, দিহান,তুর্য ওরা সবাই চেয়েছে আমি যেন ওদের সাথে দেখা করি কিন্তু সময় খুব কম। তাও ভালো যে তিনদিনের কাজ দুদিনে শেষ করতে পেরেছি বলে হাতে একদিন ফ্রি। সেই দিনও যদিও ব্যাংকে কিছু কাজ ছিলো। সেই কাজ শেষ করতে করতে দুপুর একটা বেজে গেলো। সখ বলেছিল যদি সম্ভব হয় আমি যেন অবশ্যই বাসায় যাই। আমি ঠিকানা নিয়ে রেখেছিলাম আর বলেছিলাম যদি সম্ভব হয় তবে বাসার নিচে এসে ফোন করবো। যখন দেখলাম কাজ শেষ তখন মনে হলো তাহলে সখদের বাসায় যাওয়া যেতে পারে। যদিও মূলত আমার ইচ্ছে ছিলো তাসিন তাজিমের সাথে দেখা করার বিশেষ করে ওদের বাসার ওখানে আমার পরিচিত এক বন্ধু আছেন তার সাথে দেখা করতে গেলে তাসিন তাজিমের সাথেও দেখা করা যাবে।তবে ওদিকে আর যাওয়া হলো না। উত্তরা থেকে চকলেট কিনে একটা মোটরসাইকেলে করে রওনা দিলাম। মোটর সাইকেল ওয়ালার হেলমেট আমার পছন্দ হলো না সেটা নিয়েও তার সাথে কথা বললাম। এর মাঝে মোটরসাইকেলে তেল নিলেন এবং তার কাছে খুচরা ছিলো না বলে আমি দিয়ে দিলাম। ভাড়া যেহেতু আগেই দেওয়া হয়ে গেছে তাই গাড়ি থেকে আমি নামার সাথে সাথে তিনি চলে গেলেন। আমারও খেয়াল ছিলো না যে আমার মাথায় হেলমেট আছে। পরে দেখি হেলমেটটা রয়ে গেছে। সেটা কি করে লোকটার কাছে পৌছানো যায় ভেবে ভেবে কয়েক জায়গায় আমার মোবাইল নাম্বার দিয়ে এলাম। সখদের বাসা খান টাওয়ারে। অনেক বার খান টাওয়ারের নাম উচ্চারণ করেছিলাম তাই ভাবলাম ড্রাইভার যদি বিষয়টা মনে করতে পারে তবে খান টাওয়ারের ওখানে গিয়ে খোঁজ নিতে পারবে। সে জন্যই খান টাওয়ারের নিচে হেলমেট রেখে দিলাম। এর আগে পথে বাসার জন্য মিষ্টি কিনলাম।সখের বাসার নিচে দাড়িয়ে সখের আম্মুর নাম্বারে ফোন করলাম। তিনি জানতে চাইলেন আমি কে? আমি বললাম এটা কি সখদের নাম্বার? তিনি বললেন হ্যা। তখন আমার নাম বলতেই তিনি চিনলেন। প্রথমে বিশ্বাসই করেন নি যে আমি এসেছি। তিনি সখকে নিচে নামতে বললেন তবে পরে অবশ্য সখ না মেনে ওর বাবা নেমেছে। গল্পে গল্পে জানা হলো আমি এসেছি শুনে নাকি সখের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল এক্সাইটমেন্টের কারণে।
28 জুলাই 2020