Thursday, March 28, 2024
Homeস্মৃতিকথাআমার দেখা একজন শাকুর মজিদ

আমার দেখা একজন শাকুর মজিদ

সে এখনো তারুণ্যদীপ্ত,যদিও তাঁর চুল পেকেছে সাদা
যদিও সে তিন কুঁড়ি বসন্ত পেরিয়ে আজ;
হিমালয় চূড়ার তুষার শুভ্র পাদদেশে দাঁড়ানো ।।
কাঁচা পাকা চুলের সেই মুখে এখনো খেলা করে
ঊনিশ বসন্তের প্রজাপতি, আছে আগের মতই।
ফুল ফুটে ঝরে যায়, কিন্তু সে তো কোনো ফুল নয়!
সে এখনো এক ফুলবান বৃক্ষ। তাঁর শাখা প্রশাখায়
এখনো তমালিকা-কনকচাপা ফোটে।
সে যদি ফুল হতো; তবে তো মালা হয়ে শুকিয়ে যেত
সে যদি গ্যাস ভর্তি বেলুন হতো; তবেতো
হাত ফসকে ছুটে গিয়ে মিলিয়ে যেতো সুদুর নীলিমায়
সে বরং এখন যা আছে তাই ভালো।
বর্ষার আকাশ ছেয়ে যায় কালো মেঘে
তাই বলে কি আজীবন অন্ধকারে তলিয়ে থাকে সূর্যটা
সেই কাঁচাপাকা চুলের তারুণ্যদীপ্ত মানুষটি
সে আজীবন এমনই রবে ভালোবাসা ভালোবাসায়।।
তাঁর অস্ত যাবার দু’শো কী পাঁচশো বছর পরও
সে থাকবে উদিয়মান;আলোকিত।
শাকুর মজিদের জন্মদিনে তাঁর সুস্থ সুন্দর জীবন কামনা করছি।
“”আমার দেখা একজন শাকুর মজিদ“”
বই পড়ার দারুণ এক নেশা ছিলো আমার। মাসে বিশ থেকে পচিশটা বইও এক সময় পড়েছি। সেই নেশায় বুদ হয়ে থাকার সময়ে একদিন হাতে এলো ” হুমায়ূন আহমেদঃ যে ছিল এক মুগ্ধকর” এবং ” নুহাশ পল্লীর এই সব দিন রাত্রি” বই দুটি। দুটি বই ই হুমায়ূন আহমেদ কেন্দ্রীক। আগ্রহ নিয়ে পড়তে বসে দেখি এতো সাবলীল ভাবে লেখা যে বিরতিহীন ভাবে পড়ে শেষ করা যায়। লেখার ধরন এবং শব্দচয়ন,পারিপার্শ্বিক বর্ণনা সবই আমাকে মুগ্ধ করে। সেই প্রথম শাকুর মজিদ নামটি আমি জানতে পারি। এর পর তাঁর লেখা ” ক্লাস সেভেন ১৯৭৮” পড়ি। ক্যাডেট কলেজ লাইফ নিয়ে যতগুলো বই লেখা হয়েছে তার মধ্যে এটি অবশ্যই অন্যতম সেরা একটি বই। এছাড়াও “ক্যাডেটের ডায়েরি” পড়ি। পরবর্তীতে অবশ্য “বুয়েট কাল” সহ অন্যান্য বইও পড়েছি। তাঁর লেখার ধরন এবং লেখার বিষয়বস্তু আমাকে মুগ্ধ করে। জানতে পারি লেখক একজন স্থপতি,ভ্রমনকাহিনীকার,ফটোগ্রাফার এবং নাট্যকার। তাঁর “লন্ডনি কন্যা” নাটকটিও দেখি এবং ভালো লাগে। একটু একটু করে শাকুর মজিদের অন্যান্য বইও পড়ে তাঁর সম্পর্কে কিছু জানার সুযোগ হয়। ভাবি কোনো একদিন নিশ্চই লেখকের সাথে দেখা হবে।
১.
এর পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। বইমেলা শুরু হয়েছে। এক বিকেলে বইমেলায় গিয়ে বাংলা একাডেমী প্রান্তে পুকুর পাড় দিয়ে হাটতে গিয়ে চোখে পড়লো শাকুর মজিদ দাঁড়িয়ে আছেন। বেশ কয়েকজন মিলে গল্প করছেন। যতটুকু মনে আছে সেই সময়ে সাথে ছিলেন Reza Ghatok । যেহেতু তিনি অন্যদের সাথে গল্প করছেন তাই আমি হাই হ্যালো করে বিদায় নিয়েছি। যেটা তার মনেও থাকার কথা নয়। তার পর সেদিনই বেলা পড়ে গেলে দেখলাম তিনি একাকী বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখছেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে তাঁর সাথে কথা বললাম। বললাম আমি তাঁর কোন কোন বই পড়েছি। তিনি বেশ অবাক হলেন এই ভেবে যে তাকে আমি চিনে নিয়েছি। সেটাই শাকুর মজিদের সাথে আমার প্রথম পরিচয়।
ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম শাকুর মজিদ বাইরে থেকে যতটা গম্ভীর মনে হয় আদতে তিনি অনেক মিশুক এবং এক কথায় অসাধারণ। আমাকে তিনি একাধিক বার তাঁর অফিসে দাওয়াত করেছেন কিন্তু আমি যেহেতু সাধারণত কারো সাথেই দেখা করি না তাই নানা অজুহাতে এড়িয়ে গিয়েছি।
২.
সেবার তাঁর জন্মদিনের একটা বেশ বড়সড় আয়োজন করা হলো Cadet College Club Gulshan এ। তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন আমি যেন সেই আয়োজনে উপস্থিত হই। আমার মত সাধারণ একজনকে তিনি তাঁর জন্মদিনে বাছাই করা মেহমানদের সাথে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দেখে মুগ্ধতা আরও বাড়লো। ততোদিনে তাঁর অন্যান্য ক্যাডেট কলেজ বন্ধু এবং লেখকদের সাথেও আমার ফেসবুকে পরিচয় ঘটে গেছে। আমি সময়মত ক্লাবে উপস্থিত হলাম। দেখতে পেলাম একদিকে লেখক ইকরাম কবীর হেটে বেড়াচ্ছেন। ইকরাম কবীরের লেখাও ততোদিনে আমার বেশ কিছু পড়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি যখন শাকুর মজিদের সাথে আমার দেখা হলো এবং শুভেচ্ছা জানালাম ঠিক তখন। তিনি তাঁর ছেলেকে ডেকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। যদি ভিডিও করে সেই দৃশ্যটি রাখতে পারতাম তবে আপনারা দেখলে অবাক হতেন। বোধহয় ওরকম অনুভূতি আমার জীবনে খুব কমই ঘটেছে। তিনি ইবনকে (ইবন শাকুর মজিদের ছোট ছেলে) ডেকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁর কন্ঠে সেদিন এতোটা উচ্ছাস ছিলো যে মনে হচ্ছিল তিনি জাজাফীকে নয় বরং বিশ্ব বিখ্যাত কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। তিনি ইবনকে বললেন এই দেখো কে এসেছে! এই হলো সেই জাজাফী যাকে কেউ দেখেনি,যার কন্ঠ কেউ শোনেনি! আমি বুঝলাম তিনি আগেই আমার কথা তাদের কাছে আলোচনা করেছেন। অবশ্য ইবন আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড হিসেবে ছিলো সেই হিসেবে ইবন আমার নাম জানতো হয়তো বা।
৩.
এরপর শাকুর মজিদের সাথে ফেসবুকে মেসেজে নানা বিষয়ে আলোচনা হতো। তিনি তার নতুন নতুন লেখা আমাকে পড়তে দিতেন আমিও আনন্দের সাথে পড়তাম এবং মতামত দিতাম। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আমি যে দুজন মানুষকে অগ্রিম বলেছি খুব শিঘ্রই আপনি বাংলা একাডেমী পদক পাবেন তাদের মধ্যে শাকুর মজিদও একজন। আমার কেনো যেন মনে হতো ভ্রমন সাহিত্যে যাদেরকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে তাদের তুলনায় শাকুর মজিদ এবং ফারুক মঈনুদ্দিনের লেখা অনেক সমৃদ্ধ অথচ এ দুজনকেই পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তার পর সত্যি সত্যি একবছর পরই শাকুর মজিদ বাংলা একাডেমী পদক পেলেন। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আমিও ছিলাম। ওই বছর একটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন শাকুর মজিদ। তবে আল্লাহর রহমতে তিনি অল্পের উপর দিয়ে গেছেন। হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল। সেই অবস্থায় তিনি পুরস্কার গ্রহণ করলেন।অনুষ্ঠান শেষে বাংলা একাডেমী ভবনের সামনে তার ছেলে ইবন এবং তার স্ত্রীকে সহ আমার সাথে দেখা হলো। ক্যাডেট কলেজে ক্লাবের সেদিনের মত এই দিনও তাঁর কন্ঠে দরদ ছিলো। তিনি স্ত্রী পুত্রর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। উচ্ছাসের সাথে একই ভাবে বললেন এই হলো সেই বিখ্যাত জাজাফী যাকে মানুষ খোঁজে কিন্তু দেখা পায় না। তাঁর কথা শুনে আমার বেশ সংকোচ লাগছিল। সাধারণ এই আমাকে এতোটা অসাধারণ ভাবে উপস্থান কোনো দিন কেউ করেনি।
৪.
শাকুর মজিদ ছোটদের খুব ভালোবাসেন ঠিক আমি যেমন ভালোবাসি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশী যে সব শিশু কিশোর কিশোরী অভিনয় করে.মডেলিং করে তাদের নিয়ে একটি গেটটুগেদার আয়োজন করা হয়েছিল মিরপুর ফিনান্সিয়াল ম্যানজমেন্ট একাডমী (ফিমা) ক্যাম্পাসে। অতিথি হিসেবে কাকে কাকে আমন্ত্রণ জানানো যায় এটা জানতে চাইলে আমি সবাইকে এক বাক্যে শাকুর মজিদের কথা বললাম। আমার কথা শুনে মায়মুনা ইসলাম মেধা শাকুর মজিদকে আমন্ত্রণ জানালো। মেধার আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি সানন্দে রাজি হলেন। আমিও আরেক দফা আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি সেদিন বিকেলের ফ্লাইটে সিলেটে যাবেন এটা আগেই জানিয়েছিলেন তার পরও তিনি সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সময়মত উপস্থিত হয়েছিলনে এবং ছোটরা সবাই খুবই খুশি হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্র পরিচালক আবু রায়হান জুয়েলও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শাকুর মজিদ তার লেখায় যেমন অসাধারণ তেমনি মানুষ হিসেবেও অসাধারণ।
৫.
সীগাল হোটেলের প্রশস্থ আঙ্গিনায় বিকেল থেকে সঙ্গীত আয়োজন চলে। ভোজনরসিকরা সেখানে বসে খায় আর গান শোনে বা বড় পর্দায় যেটা ভেসে ওঠে সেটা দেখে। গল্প করে। এক সন্ধ্যায় আমার ফোন বেজে উঠলো। শাকুর মজিদের ফোন। তিনি বললেন জাজাফী তুমি যদি ফ্রি থাকো তবে সীগালে চলে আসো আড্ডা হবে। আমিতো সব সময়ই বলতে গেলে ফ্রি। তাকে বললাম আধা ঘন্টার মধ্যে আসছি। তার পর সীগালে উপস্থিত হলাম তিনি সেদিন আমাকে ওখানে ডিনারও করালেন। অনেক গল্প হলো তার লেখালেখি,ভ্রমন,ছবি তোলা,নাটক সহ অনেক কিছু নিয়ে। এমনকি Khijir Hayat Khan কে নিয়েও গল্প করলাম। জানতে চাইলাম আপনার ক্লাস সেভেন ১৯৭৮ নিয়ে শুনেছি খিজির হায়াত খান সিনেমা বানাবেন সেটার কতদূর। এমন অনেক গল্প হয়েছে তাঁর সাথে। একসাথে হেটেছি সমুদ্র সৈকতে।
৬.
প্রখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ সহ শাকুর মজিদ একটি বিশেষ আমন্ত্রণ পেয়ে কক্সবাজার সাংস্কৃতিকেন্দ্রে আসলেন। আমাকে ফোনে জানালেন জাজাফী তুমি ফ্রি থাকলে একবার দেখা করে যেও। আমি সময় জেনে নিয়ে তাদের সাথে দেখা করে আসলাম। মামুনুর রশিদ এবং শাকুর মজিদ আসছেন জেনে আমাকে কয়েকজন বললো তারাও যেতে চায়। আমি শাকুর মজিদকে বিষয়টি বলতেই তিনি বললেন ঠিক আছে সবাইকে নিয়েই আসো।
আমি যতটুকু দেখেছি,যতটুকু জেনেছি,যতটুকু পড়েছি এবং যতটুকু বুঝেছি তাতে শাকুর মজিদের লেখা মুগ্ধকর এবং তার ব্যবহার আরও মুগ্ধকর। একবার এক ফেসবুক লাইভে Juena Al Din তাকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি সানন্দে আমাদেরকে সময় দিয়েছিলেন।
৭.
শাকুর মজিদ বাংলা একাডেমী পদক পাওয়ার এক বছর আগে আমি একাধিক বার উইকিপিডিয়াতে তাঁর নামে নিবন্ধ লিখেছি যথেষ্ট তথ্যসুত্র সহ। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞ উইকিপিডিয়া প্রশাসকগণ কী মনে করে তা বার বার রিমুভ করেছে। তার পর যখন তিনি বাংলা একাডেমী পদক পেলেন তখন তার নামে নিবন্ধটি এপ্রুভ হলো। উইকিপিডিয়ার এই বিষয়টি আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। বড় পুরস্কার না পাওয়া পযর্ন্ত বিশ বা পঞ্চাশটা বই লিখলেও তার নামে উইকিপিডিয়ায় নিবন্ধ হওয়ার যোগ্য নয়!
শেষ কথাঃ
শাকুর মজিদ এতোটাই বিনয়ী এবং নিরহংকারী যে আমি বোধহয় বলতে পারি আমিই শুধু তাঁর ফ্যান নই বরং তিনি নিজেও আমার ফ্যান যদিও আমি না কোনো লেখক,কবি বা বিখ্যাত কেউ। আমাকে স্নেহ করেন,ভালোবাসেন এবং লেখালেখি সহ অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ দেন। তাঁর ” মহাজনের নাও” এবং ” ভাটির পুরুষ” তাকে স্মরণীয় করে রাখবে। আমার খুবই প্রিয় বন্ধু এবং আমার সময়ে আমার সমবয়সী বা কাছাকাছি বয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী এবং বোদ্ধা হিসেবে আমি যার কথা সবার কাছে বলি সেই Moshiur Rahman ও একদিন আমাকে বলেছিলেন শাকুর মজিদ যদি আর কোনো দিন কিছু নাও লেখেন তবুও তার ” মহাজনের নাও” এবং ” ভাটির পুরুষ” তাকে ইতিহাসের পাতায় ঠাই দেবে।
তাঁর জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তিনি এমনই থাকুন এবং এই দিন বার বার ফিরে আসুক আনন্দ নিয়ে।
— জাজাফী
২২ নভেম্বর ২০২১

Most Popular