উপলব্ধি

0
408
রাতে খুব অস্থির লাগছিল আরিশের। অস্থিরতায় ভালো মত ঘুম হলো না। বার কয়েক ঘুম ভেঙ্গে গেল। অথচ তার অস্থির হওয়ার কথা ছিল না।রাত পোহালেই পরীক্ষার ফলাফল বের হবে এটাই কি তার অস্থিরতার প্রধান কারণ নাকি ফলাফল জানার পর বাবা তার জন্য কী উপহার রেখেছেন সেটা জানার জন্য অস্থিরতা সে বুঝে উঠতে পারছে না। পড়াশোনা বা রেজাল্ট নিয়ে বিগতদিনে কখনোই সে চিন্তা করেনি। কিন্তু জীবনের সর্বচ্চ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগে তাকে এমন উদ্বেগে ফেলে দিবে সে ভাবতেই পারছে না। পরীক্ষা যে খারাপ হয়েছে তাও নয়। তবুও তার মনে অস্থিরতা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করে কোনো মত নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়লো আরিশ। আরিশকে দেখে ওর মা বেশ অবাক হলো। ছেলের বয়স হয়েছে তবুও রোজ সে গিয়ে জাগিয়ে না তুললে আরিশের ঘুমই ভাংতে চায় না। সেই ছেলে কি না আজ একা একাই ঘুম থেকে উঠেছে। তাও রোজ যে সময়ে তাকে ডাকাডাকি করে জাগাতে হয় তারও অনেক আগে! আরিশ বেরিয়ে যেতেই হঠাৎ মনে পড়লো আজতো আরিশের মাস্টার্সের রেজাল্ট দিবে। সে কারণেই হয়তো ছেলেটা এতো দ্রুত বেরিয়ে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি আসতে তখনো বেশ দেরি। কিন্তু অন্যদিনের মত সে গড়িমশি করেনি। বাসা থেকে নেমেই একটি রিকশা নিয়ে রাজলক্ষ্মী স্টপেজে গিয়ে অপেক্ষা করেছে। এই বাসটির নাম ক্ষণিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাজিপুর পযর্ন্ত চলাচল করে। একবার আরিশের খুব কাছের বন্ধু ফরিদ এই বাস কমিটির সভাপতি হয়েছিল। সে নিয়ে কতশত মজার স্মৃতি জমা হয়ে আছে আরিশের মনে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই বাস চলে এলো। বাস আসতেই মাঝামাঝি একটি উইন্ডো সিটে গিয়ে বসলো। জানালার কাচ সরিয়ে সারাপথ কখনো আকাশ,কখনো ছুটে চলা গাড়ি আর রাস্তায় নানা পণ্য বিক্রি করা হকারদের দিকে তাকিয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলো। মানুষের জীবন কতইনা বিচিত্র। আরিশ দেখলো একটি ছেলে বয়স কতইবা হবে বার কিংবা তের সে মাথায় এক কেস পানির বোতল নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করছে। ওর বয়সে আরিশ বই খাতা নিয়ে স্কুলে যেত। কোনো চিন্তা ছিলো না। অথচ ছোট্ট ছেলেটির মাথায় ওগুলো শুধু পানির বোতল নয় একটি সংসারের বোঝা। এতো অল্প বয়সে সে একটি সংসারের বোঝা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পানি পানি বলে চিৎকার করে সে কাস্টমার খুঁজছে। কোনো একটি বাস একটু স্লো হতেই উঠে পড়ছে। দুই এক বোতল বিক্রি হচ্ছে আবার হচ্ছে না। তার পর চলন্ত বাস থেকেই নেমে পড়ছে অন্য বাসে উঠবে বলে।
ওর মত বয়সী একটি মেয়ে হাতে বাচ্চাদের উপযোগী বই নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করছে। আরিশের ভাবনায় রাজ্যের বিস্ময়। অবাক হয়ে সে ভাবতে থাকে একটি মেয়ে যে অন্যদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোর জন্য বই বিক্রি করছে অথচ নিজে থাকছে শিক্ষা বঞ্চিত! ঠিক যেন একটি মোমবাতির মত। নিজে অন্ধকারে থেকেও যে চারপাশ আলোকিত করে রাখে। কিছু মোটরসাইকেল আরোহী বেপরোয়া গতিতে গাড়ির ফাক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে মনে হচ্ছে সে রেসিং ক্লাবে আছে। আরিশের মনে পড়ে যায় একবার সে একটি ট্রাকের গায়ে নীতি কথা লেখা দেখেছিল। সেখানে লেখা ছিল সন্তানকে বাইক নয় জীবন দিন! সত্যিইতো বেপরোয়া গতিতে এভাবে মোটরসাইকেল চালানোর কারণে রোজ কতইনা দুর্ঘটনা ঘটে। আরিশ দেখলো একটু জ্যাম হলেই কোনো কোনো মোটরসাইকেল আরোহী অপেক্ষা না করে ফুটপাতে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দিচ্ছে। পথচারিরা পড়ছে বিপদে। তারা কিছু বলতেও পারছে না। আরিশের মনে পড়ে বাবার সাথে একবার গুলশান গিয়ে দেখেছিল রাস্তায় সাইনবোর্ড টাঙ্গানো শেষ নবাবের বংশধররা ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল চালায়। এসব বিচিত্র ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আরিশ এগিয়ে যেতে থাকে। খোলা জানালায় মুখ রেখে সে আজ সব কিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। উপলব্ধি করে নিজের মত করে। আগে এমন সব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সে কখনো চিন্তাও করেনি।
আজকের দিনটি তার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আনুষ্ঠানিক ভাবে আজই তার শিক্ষা সফর শেষ হচ্ছে। যদিও সে জানে একবার শিক্ষার্থী হিসেবে নাম লেখালে মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত কখনো ছাত্রত্ব যায় না। যারা শিখতে চায় তাদের শেখার কোনো শেষ নেই। কিন্তু সে জানে না সে তেমন শিক্ষার্থী কি না। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই আছে দিন রাত এক করে দিয়ে সারাক্ষণ বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকে। এ যেন এক নেশার মত। এই ঘোরলাগা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারে না। কিন্তও ওরা সবাই একাডেমিক পড়ায় এতো আনন্দ কোথা থেকে পায় সেটাও আরিশের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়। আরিশ ভাবে সে কি কখনো সেভাবে পড়ালেখায় বুদ হতে পেরেছে? কখনোই পারেনি। এভারেজ ছাত্র সে। কোনোদিন সে প্রথম-দ্বিতীয় হয়নি বা হওয়ার চেষ্টাও করেনি। প্রথম-দ্বিতীয় হতে গিয়ে জীবনের বাকি সব সাধ আহ্লাদ সে জলাঞ্জলী দিতে চায়নি।
সে চারুকলার বন্ধুদের পাশে বসে ছবি আঁকা দেখেছে, নাট্যকলার বন্ধুদের সাথে গিয়ে থিয়েটারে নাটকের রিহার্সেল দেখেছে। কখনো কখনো দৃষ্টিহীন বন্ধুদের জন্য বই থেকে পড়ে রেকর্ড করে দিয়েছে। টিএসসিতে একটা কনসার্টও সে মিস করেনি। বইমেলার একটি দিনও সে মিস করেনি। মিরপুর স্টেডিয়ামে এমন কোনো ম্যাচ নেই যেখানে দর্শক হিসেবে তাকে পাওয়া যায়নি। ঈদের সময় গ্রামে গিয়ে পুকুরে নেমে সাতার কেটেছে। কাজিনদের সাথে ফুটবল খেলেছে,ক্রিকেট খেলেছে,ক্যারমবোর্ড খেলেছে আবার সাইকেল চালিয়েছে। একুশের প্রভাত ফেরিতে তাকে দেখা গেছে,পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলেও দেখা গেছে। ষোলই ডিসেম্বরে সে ছুটে গেছে স্মৃতিসৌধে। আরিশের বন্ধু অনুভব থাকে পুরানঢাকায়। অনুভবের সাথে সে পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে যত বিরিয়ানির দোকান আছে সবগুলোর স্বাদ নিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদেন নতুন বই প্রকাশের সাথে সাথে তা সে কিনে এনে পড়েছে। আর একাডেমিক পড়া পড়েছে এরই ফাঁকে ফাঁকে। ফলে সে সব কিছুতেই মিশে ছিলো তার মত করে। কিন্তু তার অনেক বন্ধু শুধু একাডেমিক পড়া নিয়েই রাত দিন কাটিয়ে দিয়েছে। পরীক্ষার ফলাফলে সেই সব বন্ধু সবচেয়ে ভালো নাম্বার পেলেও আরিশের কখনো মন খারাপ হয়নি। কারণ সে জীবনকে দারুন ভাবে উপভোগ করেছে। তার যে সব বন্ধু প্রচন্ড মেধাবী তারা জানে ষাটগম্বুজ মসজিদে ৮১টি গম্বুজ আছে যদিও নাম ষাট গম্বুজ মসজিদ। কিন্তু তারা জানে না এই মসজিদের উত্তর দিকে কয়টি গাছ আছে। তারা জানে না সেগুলো আমগাছ না পেয়ারা গাছ। তারা জানে না খানজাহান আলীর মাজারে কোন পার্শ্বে পুকুর আছে। তারা জানে না সিলেট শহর থেকে জাফলং যেতে কতটাকা ভাড়া লাগে। কিন্তু আরিশ জানে। তথ্য মুখস্থ করার জন্য শুধু বই না পড়ে সে ঘুরে বেড়িয়েছে ইচ্ছেমত। মধুমিতা সিনেমা হলে গিয়ে দারুণ সব সিনেমা উপভোগ করেছে। শিল্পকলায় গিয়ে হেনরিক ইবসেনের নাটক দেখেছে। তার জীবনে অপূর্ণতা নেই।
ছোটবেলা থেকেই সে দেখেছে তার উপর কখনো কেউ কিছু চাপিয়ে দেয়নি বরং তাকে নানা ভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ভালো কিছু করতে পারলে পুরস্কৃত করা হবে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে ফলে নিজ থেকেই সে ভালো করার তাগিদ অনুভব করেছে। ফলও পেয়েছে। আর বাবা মাও সব সময় কথা রেখেছেন। নানা রকম উপহার দিয়েছেন। আরিশের আলমারি জুড়ে আজও সেই সব উপহারের অনেকাংশই শোভাবর্ধন করে রেখেছে।
দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। বাবা মায়ের চোখের সামনে ছোট্ট আরিশ কিশোর থেকে তরুণ হয়েছে তার পর যুবক হয়ে উঠেছে। তার এই পথচলা হাসি আনন্দে ভরপুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের জানালায় মুখ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে এক খন্ড ভেসে যাওয়া মেঘ দেখতে দেখতে আরিশের মনের মধ্যে ফেলে আসা সেই সব দিনের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে আজও বাবা তার জন্য একটি উপহার রেখেছেন। আজকের উপহারটা নিশ্চই আগের সব উপহারের চেয়ে দামী হবে, সেরা হবে। আজ যে শিক্ষা জীবনের সবচেয়ে বড় ডিগ্রিটা সে পেতে চলেছে।যতদূর মনে পড়ে সে পরীক্ষা ভালোই দিয়েছিল। যে রেজাল্ট হবে তা তাকে হতাশ করবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই শাহবাগ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি টিএসসিতে এসে থামলো। আরিশও গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্ত্বর হয়ে কার্জন হল পযর্ন্ত যে শান্ত সুন্দর রাস্তাটি ছিল তা এখন তার সৌন্দর্য হারিয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে মেট্রোরেল কার্যক্রম শুরু হওয়ার সাথে সাথেই টিএসসি তার রুপ লাবণ্য হারিয়ে ফেলেছে। টিএসসির উপর দিয়ে মেট্টোরেল যাবে বলে সিদ্ধান্ত হওয়ার পর কত আন্দোলন হলো কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। আরিশের মনে পড়ে সে তার যে সব বন্ধু আন্দোলন করেছিল তাদের বলেছিল এমন ঢিমেতেতালা আন্দোলন করে কোনো লাভ নেই। তারা তা শোনেনি। অবশেষে চোখের সামনেই মেট্রোরেলের কাজ চলতে শুরু করলো। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। রাজু ভাস্কর্য ঢাকা পড়ে যাবে মেট্রোরেলের নিচে। টিএসসিতে বসে এখন আর সোহরাওয়ার্দি উদ্যান চোখে পড়ে না। চারুকলা থেকে চোখ ফেরালেই ছবির হাট দেখা যায় না।
চোখের পলকে কত কিছু বদলে যাচ্ছে ভাবতেই অবাক হয় আরিশ। কিছুদিন আগেও নীলক্ষেত মোড়টা ফাঁকা ছিলো এখন সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন একটি তোরণ নির্মান করা হয়েছে। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে বাস থেকে নেমে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দশটা বাজতে দেরি আছে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সে হাটতে হাটতে চলে গেলো ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায়।কত শত স্মৃতি জমা হয়ে আছে এই ক্যাফেটেরিয়া ঘিরে। কত আড্ডা,হাসি আনন্দের সাক্ষী সে। আর কিছুদিন পর আরিশ খুবই মিস করবে এই ক্যাফেটেরিয়া। ক্যাফেটেরিয়ার পেছনে ইতিহাস হয়ে দাড়িয়ে থাকা মধুর ক্যান্টিন। অথচ আরিশের কত বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করে দিলেও কোনোদিন মধুর ক্যান্টিনের ভিতরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। আরিশ ভেবে পায় না ওদের কী নিয়ে এতো ব্যস্ততা। একটাইতো জীবন তা যদি জীবনের মত উপভোগ করতে না পারে তবে এ জীবনের সার্থকতা কোথায়? ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার এক কোণায় চেয়ারে বসে এক কাপ চা আর দুটো সিঙ্গাড়া খেতে খেতে মুহূর্তের মধ্যে আরিশ যেন ফিরে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো পুরোনো দিনে। মনে পড়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার কথা। বাবা মা বলেছিলেন চাইলে বিদেশে গিয়ে পড়তে পারো কিন্তু আরিশ তা চায়নি। আরিশের অন্য বন্ধুরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পড়তে চলে গেলেও আরিশ চেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। যেখানে বাবা মা দুজনেই পড়েছেন। সেই সংকল্প থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর কত নতুন বন্ধু হলো। সব আজ মনের মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে। আরিশ ভাবছে মানুষ যত বড় হয় সে আসলে সব কিছু হারাতে থাকে। স্কুল পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হতেই স্কুলের বন্ধুদের হারিয়েছে। কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেই কলেজের বন্ধুদের হারিয়েছে। তার পর এই যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে যখন চাকরি জীবনে প্রবেশ করবে তখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে সব বন্ধু ছাড়া মনে হতো জীবনটাই অচল তারাও হারিয়ে যাবে। শুধু কি বন্ধু হারায়? হারিয়ে যায় জীবনের অনেক দামী সম্পদ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষ শৈশব হারায়, কৈশর হারায়,যৌবন হারায়। জীবন জীবিকার তাগিদে বাবা মা পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়। তারপর একদিন ডাক এলে পৃথিবীটাও হারাতে হয়। চলে যেতে হয় শুন্য হাতে।
আরিশ মনে মনে ভাবে আজ তার কী হয়ে গেল। এতো সব ভাবনা কেন তার মনের মধ্যে উকি দিচ্ছে। জীবন নিয়ে সে তো কখনো ভাবেনি। আজ কেন তবে সব মনে পড়ছে। তারপর সে মনটাকে শান্ত করে কলাভবনের দিকে হাটতে লাগলো। কলাভবনের প্রধান ফটকের সামনে মাথা উচু করে ওইতো দাড়িয়ে আছে অপরাজেয় বাংলা নামে এক ভাস্কর্য। ওদিকে একবার তাকিয়ে সে কলাভবনে ঢুকে পড়লো। আজ তার স্নাতকোত্তরের ফলাফল প্রকাশ হবে।এ এক আনন্দের মুহূর্ত। এর আগেও জীবনে অনেকগুলো পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে তবে আজকেরটা তার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর পর যে তাকে আর কোনো একাডেমিক পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।
বিভাগীয় নোটিশ বোর্ডে সদ্য টাঙ্গানো রেজাল্ট শীটে নিজের নাম দেখার সাথে সাথেই আরিশের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে যা কল্পনাও করেনি তেমন ফলাফল হয়েছে। প্রথম শ্রেণীতে তের তম হয়েছে! সে যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। জীবনটাকে উপভোগ করতে করতে পরীক্ষা দিয়ে এতো ভালো ফলাফল হওয়াটা তার কাছে অবিশ্বাস্য। সে আর দেরি না করে বিভাগীয় অফিস থেকে রেজাল্টশীটের একটি কপি নিয়ে বাসায় ফিরলো। বাবা মা এই ফলাফলে অনেক খুশি হবেন। বাসায় ফিরে বাবার হাতে নিজের রেজাল্টশীট ধরিয়ে দিয়ে আরিশ অপেক্ষা করতে লাগলো। ছেলের রেজাল্ট দেখে বাবা ভীষণ খুশি হলেন। তিনি আরিশের কাঁধে হাত রেখে বললেন আমি তোমার রেজাল্টে খুবই খুশি হয়েছি। তুমি আমার মুখ উজ্জল করেছ। বরাবরের মতই আমি আজও তোমাকে একটি উপহার দিতে চাই। আরিশ মনে মনে এই উপহারের অপেক্ষায় ছিলো। সে কখনো কল্পনাও করেনি বাবা তাকে এবার কী উপহার দিতে পারে। বাবা যদি তাকে অপশন দিতো বলো আরিশ তুমি কী চাও। আরিশ তখন কী চাইতো তা মনে মনে কল্পনা করে। হয়তো কিছুই চাইতো না অথবা কিছু একটা চাইতো। বাবা সেই অপশন রাখেননি। তিনি নিজেই কিছু একটা ঠিক করে রেখেছেন। বাবা তাকে সাথে করে নিজেদের গ্যারেজে নিয়ে গেলো। গ্যারেজে দুটো মাত্র গাড়ি। একটি অনেক পুরোনো মডেলের গাড়ি আরেকটি বছর পাঁচেক আগে কেনা মারুতি। বাবা তাকে পুরোনো গাড়িটির কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন আরিশ আমি তোমাকে এই গাড়িটি উপহার দিতে চাই। বহু আগে এই গাড়িটি আমি শখ করে কিনেছিলাম। ভাবলাম তোমার এই খুশির মুহূর্তে তোমাকে এই গাড়িটি উপহার হিসেবে দিই।
বাবার কথা শুনে আরিশ কিছুটা আশাহত হলো। এই গাড়িটা তার মোটেও পছন্দ না। পুরোনো মডেল দেখে আরিশ খুব একটা ওই গাড়িতে চড়তো না। ছোটবেলায় অবশ্য ওই গাড়িতে করেই সে বাবার সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেত। সে দেখতো তারা যখন ওই গাড়িতে কোথাও যেত রাস্তার মানুষ গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতো। এটা দেখে আরিশের লজ্জা লাগতো। মানুষের কী সুন্দর সুন্দর গাড়ি আর তাদের গাড়িটা কত পুরোনো,ব্যাকডেটেড। সে লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখতো। ছোট্ট আরিশ তখন কিছুই বুঝতো না। কলেজ লাইফে তাই সে আর ওই গাড়িতে চড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতেই চলাফেরা করতো। মাঝে মাঝে বাবা মায়ের সাথে কোথাও ঘুরতে গেলে নতুন গাড়িটা ব্যবহার করতো। স্নাতকোত্তর পাশ করার পর বাবা তাকে এমন একটি লজ্জাজনক উপহার দিবেন তা সে কল্পনাও করেনি কখনো। এদিকে সে বাবাকে কিছু বলতেও পারছে না। কিন্তু বাবা ঠিকই বুঝলেন এই উপহার ছেলের পছন্দ হয়নি। ছোটবেলা থেকেই গাড়িটা আরিশ পছন্দ করতো না। বাবা সেটাও বুঝতেন। তিনি ওকে বলতেন বড় হলে অনেক কিছু উপলব্ধি করতে পারবে।
বাবা জানেন আরিশ এখন বড় হয়েছে তাই তার উপলব্ধি করার মত সময় এসেছে।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আরিশের বাবা তাকে বললেন আমি জানি তুমি এই উপহার পেয়ে খুশি হওনি। কারণ তুমি ভেবেছ বাবা কেন আমাকে পুরোনো মান্ধাতার আমলের এই অচল গাড়িটা উপহার দিলো। ভালো গাড়িটা কেন দিলো না? আরিশ বাবার কথায় খানিকটা লজ্জা পেলো। কিন্তু বাবা তাতে কিছু মনে করলো না। আরিশকে বললো তুমি চাইলে এই গাড়িটা বিক্রি করে নতুন গাড়ি কিনতে পারো। অতিরিক্ত কিছু টাকা লাগলে আমি তোমাকে দিয়ে দেবো। তাই তুমি এক কাজ করো গাড়িটি পুরোনো গাড়ি বিক্রি হয় এমন শো রুমে নিয়ে যাও। দেখো তারা কত দাম দিতে চায়। তবে যে দামই দিক সাথে সাথে গাড়ি বিক্রি করবে না বরং আমার কাছে ফিরে আসবে। পরে সিদ্ধান্ত হবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরিশ গাড়িটি নিয়ে বেরিয়ে গেল। যেহেতু বাবা বলেছেন অতিরিক্ত টাকা লাগলে তা তিনি দিবেন। তবে আরিশের তেমন আশা নেই। এই মান্ধাতার আমলের গাড়ি বড়জোর দুই লাখ টাকায় বেচা যাবে তাও কেউ কিনবে কি না সন্দেহ। আশা নিরাশার দোলাচালে ভুগতে ভুগতে আরিশ একটি পুরাতন গাড়ি বিক্রি হয় এমন শো রুমে নিয়ে তাদেরকে বললো এই গাড়িটি বিক্রি করতে চাই। আপনারা কিনবেন কি না। তারা বললো এটি ৭ লাখ টাকা হলে তারা কিনতে রাজি আছে। আরিশ কিছুটা অবাক হলো। সে ভেবেছিল দুই লাখ টাকাও হবে না আর এরা ৭ লাখ দিতে চাইছে। ইচ্ছে করছিল তখনই গাড়িটি বিক্রি করে দেয় কিন্তু বাবার বলা কথাটা মনে পড়তেই সে জানালো বাসায় কথা বলে পরে জানাবো। তার পর সে ফিরে আসলো।
বাসায় ফিরে দেখলো বাবা তখনো গ্যারেজের সামনেই অপেক্ষা করছে। ফিরে এসে সব বিস্তারিত জানালো। বাবা বললেন এবার তুমি এই গাড়িটা নিয়ে কোনো একটি ভাঙ্গারির দোকানে যাও। দেখো তারা কত দাম বলে। অলরেডি আরিশ বিষয়টি উপভোগ করতে শুরু করেছে। সুতরাং বাবা বলার সাথে সাথে সে চলে গেলো ভাঙ্গারির দোকানে। গিয়ে একই ভাবে বললো গাড়িটি বিক্রি করতে চায়। তারা সব দেখে শুনে ওজন করে বললো ১ লাখ টাকা হলে তারা কিনতে রাজি আছে। আগের দোকানের মতই আরিশ একই কথা বলে ফিরে আসলো। এসে বাবাকে বিস্তারিত বললো এবং এবার সে নিজ থেকেই জানতে চাইলো বাবা এবার কি আরও কোথাও যাওয়ার সুযোগ আছে? বাবা বুঝলেন আরিশ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। তিনি বললেন এই গাড়িটি নিয়ে উত্তরা ক্লাবে চলে যাও। বাবার উত্তরা ক্লাবের মেম্বারশীপ আছে। আরিশ অনেকবার বাবার সাথে ক্লাবে গিয়েছে। ক্লাবের সদস্য আংকেলদের অনেকেই আরিশকে চেনে। সুবাইতার বাবাও ওই ক্লাবের সদস্য। সুবাইতা আর আরিশ একই স্কুলে পড়তো। পরে সুবাইতা পড়াশোনার জন্য সুইজারল্যান্ড চলে গেছে। তবে ফেসবুকে এখনো যোগাযোগ হয়।
আরিশ পুরোনো মডেলের গাড়িটি নিয়ে উত্তরা ক্লাবে হাজির হলো। গিয়ে দেখলো মির্জা শাফায়েত আংকেল বসে কফি খাচ্ছেন। পাশেই খবরের কাগজ হাতে বসে আছেন আফতাব আংকেল। দুজনই আরিশকে চেনে। আরিশ কাছে গিয়ে সালাম দিলো। শাফায়েত আংকেল মানে সিজদার বাবা আরিশকে দেখে বললেন আরিশ কেমন আছো? আজ একাই এসেছ! বাবা কোথায়? আরিশ বললো বাবা আসেনি। আমি এসেছি একটি কাজে। শাফায়েত সাহেব জানতে চাইলেন কী কাজ? আরিশ বললো বাবা আমাকে আমাদের পুরোনো মডেলের গাড়িটি উপহার দিয়েছেন। আমি ওটা বিক্রি করে নতুন গাড়ি কিনবো। বাবা বললেন ক্লাবে আসতে। যদি এখানকার কেউ গাড়িটি কিনতে চায়। আরিশের কথা শুনে হাত থেকে কাপ নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন শাফায়েত সাহেব। আরিশের কথাটা সম্ভবত আফতাব সাহেবের কানেও পৌছেছে। তিনিও পত্রিকা রেখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ক্লাবে সেই সময়ে আরও যারা উপস্থিত ছিলেন সবাইকে জানানো হলো আরিশের পুরোনো মডেলের গাড়িটি বিক্রি হবে।
আরিশ ভেবেছিলো এই সব ধনকুবেররা আরিশের পুরোনো গাড়িটি বিক্রি করবে শুনে তেমন আগ্রহ দেখাবে না। কিন্তু আরিশ বিস্মিত হলো যখন ঘোষণা শুনে একে একে প্রায় সবাই বেরিয়ে আসলো। ক্লাবের সামনে লনে গাড়িটি পার্ক করা ছিলো। সবাই এসে গাড়িটিকে ঘিরে ধরলো। আরিশ দেখলো তাদের অনেকেই গাড়িটি কিনতে ইচ্ছুক। শাফায়েত সাহেব আরিশের কাছে জানতে চাইলেন তুমি কত টাকা হলে গাড়িটি বিক্রি করবে? আরিশ দ্বিধায় পড়ে গেল। শোরুম থেকে সাত লাখ টাকা দাম দিয়েছে আর ভাঙ্গারির দোকান থেকে এক লাখ টাকা দাম দিয়েছে সেই তথ্য এখানে উত্থাপন করা ঠিক হবে কি না সে বুঝে উঠতে পারলো না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে আরিশ বললো আপনারা সবাই বাবার বন্ধু সুতরাং আপনাদের কাছে আমি দাম চাইতে পারবো না। আপনারাই বলুন। আরিশের এমন উত্তর শুনে সবাই বেশ খুশি হলো। পাশ থেকে তুর্যর বাবা বললেন আরিশদের এই গাড়িটি আমার অনেক আগে থেকেই পছন্দ। এটা আমি নিতে আগ্রহী। শাফায়েত সাহেব জানতে চাইলেন আপনি এই গাড়ির জন্য কত দিতে রাজি আছেন? তুর্যর বাবা বললেন আমি এটার জন্য ৭০ লাখ টাকা দিতে রাজি আছি। আরিশ প্রথমে বুঝতে পারেনি যে তুর্যর বাবা আসলে কত দাম বলেছেন। তিনি কি আসলেই ৭০ লাখ বলেছেন নাকি ৭ লাখ বলেছেন। আরিশ বললো আংকেল আপনি কত দিতে রাজি আছেন বললেন? তুর্যর বাবা বললেন আমি ৭০ লাখ দিতে রাজি আছি।
টাকার অংক শুনে আরিশের আকাশ পাতাল ওলটপালট হয়ে গেল। এই মান্ধাতার আমলের গাড়ি কেউ এতো টাকা দিতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি কখনো। তার কপালে ভাজ পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল ছোট বেলায় এই গাড়িতে চড়বে না বলে সে যখন অনেক জিদ করতো বাবা তখন তাকে বলতো এখন তুমি বুঝবে না বড় হলে বুঝতে পারবে। মনে পড়ে গেলো রাস্তায় যখন এই গাড়িটা নিয়ে চলাফেরা করতো মানুষ কেন তাকিয়ে থাকতো। আর সেই সময়ে পুরোনো গাড়ি ভেবে ছোট্ট আরিশ লজ্জায় লাল হয়ে যেত। এখন গাড়ির দাম শুনে নিজেই নিজের মনে লজ্জা পাচ্ছে আরিশ।
তুর্যর বাবা ওয়াজিউল সাহেব দাম বলার পর পাশ থেকে বিক্রম সাহেব বললেন গাড়িটি তারও অনেক পছন্দ। বিশেষ করে তার ছেলে বিরল অনেক দিন থেকেই বলছে বাবা আরিশদের মত একটা গাড়ি কিনো। কিন্তু রেয়ার মডেল বলে কেনা হয়নি। তিনি এই গাড়িটি ৭৫ লাখ দিতে রাজি আছেন। আরিশ চাইলে এখনি ক্যাশ চেক দিয়ে দিতে পারবেন। আরিশোর মাথা চক্কর দিতে শুরু করেছে। বাবা তাকে এ কারণেই বলেছিলেন যে দামই হোক গাড়ি যেন বিক্রি না করে আগে বাসায় ফিরে তাকে সব বলা হয়। আরিশ আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো এবং ক্লাবের আরও দুই তিনজন সদস্য গাড়িটি কেনার আগ্রহ প্রকাশ করলো এবং শেষ পযর্ন্ত আহমেদ আংকেল দাম দিলেন ৯৫ লাখ টাকা। আরিশ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললো গাড়িটি এখনি বিক্রি করতে পারছি না। আগে বাবার সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করবো তার পর সিদ্ধান্ত নিব। তার পর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যার কিছু পর বাসায় ফিরলো আরিশ। বাবা তখন মাগরিবের নামাজ শেষ করে সোফায় বসে কফি খেতে খেতে মায়ের সাথে গল্প করছিল। আরিশ বাবার পাশে বসলো। বাবার মুখে রাজ্যের হাসি। আরিশ বুঝতে পারলো বাবা আগে থেকেই জানতেন এই গাড়ির এমন দাম! তাইতো তাকে বুঝানোর জন্য, উপলব্ধি করানোর জন্য খেলার মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন। আরিশ পাশে বসতেই বাবা জানতে চাইলেন ক্লাবে নিয়ে যাওয়ার পর গাড়ির দাম কে কেমন বললো? আরিশ বললো বাবা আমি স্বপ্নেও যা ভাবিনি তার চেয়েও বেশি দাম উঠেছে। এমন পুরোনো একটা গাড়ির দাম ৯৫ লাখ টাকা হতে পারে এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য বিষয়।
ছেলের কথা শুনে বাবা বললেন শোনো আরিশ এই গাড়িটির দাম আরও বেশি। কিন্তু এই গাড়িটি যে অনেক দামি এটা মূল বিষয় নয়। আমি তোমাকে একটি বাস্তবতা শেখাতে চেয়েছি। গরম কালে কম্বল বিক্রি করতে গেলে তা বিক্রি হয় না। মনে রেখো সঠিক জায়গায়,সঠিক লোকই কেবল তোমাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করবে। যদি কখনো কেউ তোমাকে মূল্যায়ন না করে তবে মন খারাপ করবে না বরং ভাববে তুমি ভুল মানুষের কাছে গিয়ে পড়েছ। তারাই তোমাকে মূল্যায়ন করবে যাদের নিজেদের মধ্যে মূল্যবোধ আছে। তোমার কি মনে আছে “দ্য প্রিন্স এন্ড দ্য পপারের” সেই গল্পটি? আরিশের মনে পড়ে গেল সেই সীলমোহরের কথা। ভিখারীর ছেলে রাজপুত্র হিসেবে যখন রাজপ্রাসাদে ছিল তখন সে সেই সীলমোহর দিয়ে আখরোটের খোসা ছড়াতো ! বাবা বললেন জহুরী ছাড়া অজ্ঞদের কাছে একটি হীরেও সামান্য কাচের টুকরো ছাড়া কিছুই নয়। ঠিক যেমন তোমার গাড়িটি ভাঙ্গারির দোকানে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের চোখে তা লোহালক্কড় ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি তেমন।
বাবার কথা শোনার পর আরিশ বাবার কাছে বিগত দিনের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইলো। সেই যে ছোট বেলা থেকে এই পুরোনো মডেলের গাড়িতে চড়া নিয়ে তার যে মন খারাপ হতো সেটা ভেবে সে লজ্জা পেলো। বুঝলো মানুষ এই রেয়ার মডেলের গাড়িটি দেখে বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে থাকতো। আর ছোট্ট আরিশ ভাবতো লোকে তাদেরকে ছোট চোখে দেখছে। বাবা এবার আরিশকে বললেন, বেশ ভালো দাম উঠলো গাড়িটার। তুমি তোমার পছন্দের প্রায় সব গাড়িই কিনতে পারবে। তারপরও যদি কিছু টাকা লাগে বলবে আমি দিয়ে দেব। আরিশ বললো বাবা গাড়িটা আমি বিক্রি করবো না। তুমি যে আমার জন্য এতো দামী আর দুষ্প্রাপ্য একটি উপহার রেখেছ তা আমি আগে কখনো উপলব্ধি করতে পারিনি। এখন উপলব্ধি করতে পারছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করো। আর এই অসাধারণ উপহারের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আরিশের কথা শুনে পাশ থেকে মা বললো, শোনো আরিশ! ছেলে মেয়েরা যখন ছোট থাকে তারা মনে করে বাবা মা যা করছে সবটাই ভুল। কিন্তু তারা যখন বড় হয় তখন একটু একটু করে বুঝতে পারে বাবা মা ভুল ছিলেন না। কিন্তু যখন তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। সেই সব ভুল শুধরানোর আর কোনো উপায় থাকে না। আত্মচিন্তা, আত্মপোলব্ধি বড় একটি বিষয়। যে যত দ্রুত তা আয়ত্ব করতে পারে তার জন্য ততোই ভালো।
তোমাকে দুটো গল্প বলি হয়তো তাতে তোমার আরও ভালো কিছু জানা হবে। এক লোক মনে করতো আমাদের হাত পা সব যদি খুলে আলাদা করে রাখা যেত কতই না ভালো হতো। এক রাতে সেই লোকটি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলো সে ঘুমানোর আগে তার পা দুটি খুলে ব্যাগের মধ্যে ভরে বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলের উপর রেখে তার পর ঘুমিয়েছে। মাঝরাতে হঠাৎ করে ঘরে চোর ঢুকে সেই ব্যাগটা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। লোকটির তখন কোনো উপায় নেই চোরকে ধরবে, কারণ তারতো পা নেই। সে দৌঁড়াবে কিভাবে? এই স্বপ্ন দেখে সে জেগে উঠলো এবং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো যে তিনি যেভাবে আমাদের সৃষ্টি করেছেন এটিই উত্তম। ভাগ্যিস হাত পা খুলে রাখার সিস্টেম নেই। দেখা গেলো ওই লোকটির মত ঘটনা ঘটলো। তাই আমাদের জন্য যা উত্তম সেটাই গ্রহণ করা উচিত। এমন আরেকটি গল্প বলেছিলেন এক বিখ্যাত লেখক যে এক লোকের জুতা নেই বলে তার মনে অনেক দুঃখ ছিল। পরে সে রাস্তায় হাটতে গিয়ে দেখতে পেলো সে জুতা নেই বলে আক্ষেপ করছে অথচ অনেক লোকের জুতা পরার মত পা দুটোই নেই! সে তখন তার ভুল বুঝতে পারলো। সময় থাকতে নিজের ভুল বুঝতে পারলে তা শুধরে নিতে হয়। তবেই জীবন সুন্দর হয়।
বাবা মায়ের সুন্দর সুন্দর কথা শুনে আরিশ অনেক কিছু শিখলো। এতোদিন সে কোনো কথাই গুরুত্বের সাথে নিত না ভেবে এখন খারাপ লাগছে। গুরুত্বের সাথে না শোনায় সে এক জীবনে কত কত জ্ঞানের বিষয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে ভাবতেই তার খারাপ লাগছে। পরদিন বাবার সাথে উত্তরা ক্লাবে গিয়ে পুরো বিষয়টি সবার সাথে শেয়ার করলো। আরিশের এই আত্মপোলব্ধির বিষয়টি সবার হৃদয়ে দাগ কেটে গেল। আরিশ বুঝলো প্রতিটি মুহূর্তেই আমাদের জন্য অনেক কিছু শিক্ষণীয় বিষয় থাকে। আমরা অবজ্ঞা, অবহেলার কারণে তা উপলব্ধি করতে পারি না। যদি উপলব্ধি করতে পারতাম, তবে জীবন আরও সুন্দর হতো। অনেক সমস্যা সংগঠিতই হতে পারতো না।
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০