লেখকঃ জাজাফী

বুধবার বিকেলে লিন্ডার ফোন পেলাম।আমি তখন বাইরে বের হবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় ফোন এলো।অপরিচিত নাম্বার।কান্ট্রিকোড দেখে বুঝলাম ফোন কোথা থেকে এসেছে।তবে বুঝতে পারিনি কে ফোন করতে পারে।রিসিভার তুলে কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে লিন্ডার কন্ঠ ভেসে এলো।কন্ঠ শুনে বুঝিনি যে ওটা লিন্ডা কারণ ওর সাথে আমার দেখা হয়নি বিশ বছর।আর কথা হয়েছে কালেভদ্রে মাসে দু মাসে।ম্যানহাটন জুনিয়র হাইস্কুলে আমি আর লিন্ডা একসাথে পড়তাম।গ্রেড ফোরে পড়াকালীন যখন আমি আর মম এদেশে চলে এলাম তখন থেকে একটু একটু করে লিন্ডার সাথে আমার যোগাযোগ কমতে থাকলো।ইমেইলে কথা হতো মাঝে মাঝে  তবে ফেসবুক যুগে প্রবেশের পর বেশ যোগাযোগ হয়।আমি যখন মমের সাথে ম্যানহাটনে থাকতাম তখন লিন্ডা ওর সিঙ্গেল মাদারের সাথে ম্যানহাটনেই থাকতো।ও বলেছিল ওর সিঙ্গেল মাদার তবে আমার তখনই মনে হতো আসলে কথাটি ঠিক নয়।কোন এক অজ্ঞাত কারণে ওরা বাবার কথা চেপে যেতে চায়।আমিও তাই কখনো তোড়জোড় করিনি।

লিন্ডার পুরো নাম লিন্ডা ওয়াটসন।ওর গ্রান্ডফাদার জেমস ওয়াটসন আমেরিকার প্রখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন।বাংলাদেশে চলে আসার পর লিন্ডার সাথে যোগাযোগ কমে গেলেও কখনো বিচ্ছিন্ন হইনি আমরা।স্কুল কলেজ পেরিয়ে দুজন দুই দেশের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নিজেদের মত করে দিন কাটাচ্ছি ঠিকই তবে ফেসবুকে দুজন দুজনের অম্লমধুর স্মৃতিগুলি ফ্রেমে ধরে রেখে শেয়ার করছি একে অন্যের সাথে।এর ফলে কখনো মনেই হয়নি আমরা আর আগের মত একসাথে নেই।কোন এক বিচিত্র কারণে লিন্ডার কোন বয়ফ্রেন্ড জোটেনি অথচ ও এতো সুন্দর যে একবার তাকালে সহজে চোখ ফেরানো যায় না।আমি একবার জানতে চেয়েছিলাম তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই?ও বলেছিল না নেই তবে আছে একজন কিন্তু সে আসলেই আমার বয়ফ্রেন্ড কিনা তা আমি নিজেও জানিনা কারণ তাকে কখনো কথাটি বলা হয়নি।আমি ওকে নিজ থেকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলাম তুমি তাহলে অপেক্ষা করছো কেন?বলে দাও তার পর দেখো সে তোমাকে নিশ্চই এড়িয়ে যেতে পারবে না।তুমি হলে সেই লাল শিখা যার আকর্ষণ এড়ানোর ক্ষমতা নেই কোন পোকার।পোকারা যেমন জ্বলন্ত শিখার দিকে মোহগ্রস্থের মত ছুটে যায় তেমনি সেও তোমার দিকে ছুটে আসবে।লিন্ডা অন্যমনস্ক হয়ে যায়।তবে কথা না ঘুরিয়েই বলে সে তো আর পোকা নয় আর আমিও জ্বলন্ত শিখা নই।তাছাড়া সে হলো আকাশের চাঁদের মত যাকে চাইলেই ধরা যায় না ছোয়া যায়না। তাকে দেখতে হয় দূর থেকে ছুতে হয় কল্পনায় আর আকতে হয় নিজের মনের সাতরঙে।

লিন্ডার কথাগুলো আমার খুব ভালো লাগে।কি মিষ্টি করে কথা বলে।তার চেয়েও অদ্ভুত লাগে সেই মানুষটির কথা চিন্তা করে যাকে লিন্ডা পছন্দ করে কিন্তু বলতে পারেনা ছুতে পারে না।লিন্ডাকে উপেক্ষা করার মত মানুষও যে থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না।বিকেলে লিন্ডার ফোন পেয়ে আমি বেশ পুলকিত হলাম।বেশ অনেক দিন পর ফোন করেছে এটা আনন্দের একটি কারণ তার চেয়ে বড় কারণ হলো লিন্ডা এই সামার ভ্যাকেশানে বাংলাদেশে ঘুরতে আসতে চায়।আমার বেশ আনন্দ হলো।আমি লিন্ডাকে ফোনে রেখেই মমকে বললাম যে জানো মম লিন্ডা বাংলাদেশে আসছে! আমার মুখ থেকে কথাটি শোনার সাথে সাথে মমের মুখটা যেন একশোওয়াট বাল্বের মত আলোকিত হয়ে উঠলো।মমের দিকে তাকিয়ে আমি খুবই অবাক হলাম।যেন মনে হলো লিন্ডা মমের খুব আপন কেউ অথচ মমের সাথে তার তেমন কোন সম্পর্কই ছিলনা।সেই ছোট্ট লিন্ডাকে মম খুব কমই দেখেছে।তাছাড়া আমাদের ম্যানহাটনের বাসাতেও সে একবারের বেশি দুবার আসেনি।মম আমার হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে কানে লাগিয়ে এমন উচ্ছাস প্রকাশ করলো যে লিন্ডা নিজে পারলে তখনি উড়ে চলে আসে।ও কেন বাংলাদেশে আসতে চায় তা জানিনা তবে তখন মনে হচ্ছিল মমের ভালোবাসাটুকু পাওয়ার জন্য হলেও সে বাংলাদেশে আসবেই।মম খুটিয়ে খুটিয়ে অনেক কথা জানতে চাইলেন তার পর আমার হাতে দিলেন ফোনটা।আমি আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলাম।ও অলরেডি ভিসা পেয়ে গেছে আগামী সাটারডেতে ওর ফ্লাইট।হাতের কর গুনে দেখলাম সময় বেশি দেরি নেই।

আগে কখনো বাংলাদেশে আসেনি ও।হঠাৎই বাংলাদেশ নিয়ে এতো আগ্রহ কেন সেটা প্রশ্ন উঠতে পারে তবে গ্রেড ফোরে থাকতে আমি যখন ওকে বাংলাদেশের কথা বলেছিলাম এবং বলেছিলাম আমার মম বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছে তখন ও খুবই উৎসাহী ছিল জানার জন্য।বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন আর স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই উত্তাল দিনের কথা ও কখনো ভুলতে পারেনি।বাচ্চারা যেমন দাদু দিদার কাছে রোজ রুপকথার গল্প শোনার জন্য বায়না করে ও ঠিক তেমন করতো।রোজই স্কুলে আমাকে চেপে ধরতো গল্প বলার জন্য যেন আমি নিজে ভাষা আন্দোলন করেছি আর মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিক!বলতে বলতে এমন হয়ে গেল যে ওর সব মুখস্থ।কিন্তু তারপরও ও শুনতে চাইতো।তখন বুঝিনি তবে এখন মনে হয় ও আসলে মুক্তিযুদ্ধ,ভাষা আন্দোলনের গল্প শোনার নাম করে আমার কন্ঠ শুনতে ভালোবাসতো।যেহেতু আমি মুক্তিযুদ্ধ,ভাষাআন্দোলনের স্মৃতি খুব ভালোবাসি তাই ও চাইতো আমার প্রিয় বিষয় নিয়েই যেন আমি বলতে পারি।

সন্ধ্যায় মম আমাকে রেডি হতে বললেন মার্কেটে যেতে হবে।আমি ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চাইলাম মম একটু আগেই না তুমি মার্কেট থেকে আসলে এখন আবার কেন মার্কেটে যেতে হবে?মুখে একরাশ হাসি টেনে বললেন লিন্ডা আসছে ওর জন্য ঘর গোছাতে হবে না?তাই কিছু কেনা কাটা করতে হবে।আমি দুষ্টুমীর সুরে বললাম মম তুমি এমন করছো যেন লিন্ডা নামে যে আসছে সে আসলে তোমার এখানে চিরদিন থেকে যাবার জন্য আসছে।মনে হচ্ছে সে তোমার খুব কাছের কেউ।আমার কথাটি খপ করে টেনে নিয়ে মম আমার কাধে হাত রেখে বললো তুইতো বেশ দারুণ একটি কথা বলেছিস।এটা আমার মাথায় আসেনি কেন?লিন্ডাকেতো আজীবনের জন্যই রেখে দেওয়া যায়! আমি আরো খানিকটা অবাক হয়ে জানতে চাইলাম কিভাবে রেখে দিবে?আর সেইবা কেন থাকবে?মম আমাকে বললেন কেন তুইকি আজীবন একাই থাকবি নাকি?তোর সাথে লিন্ডাকে বেশ মানাবে।মমের কথা শুনে আমি হাসিতে ফেটে পড়লাম।যদিও কথাটি খুব একটা খারাপ বলেনি।মমের সাথে মার্কেট থেকে অনেক কিছু কেনা কাটা করলাম।রাতে লিন্ডাকে ফেসবুকে মেসেজ দিলাম সে বাংলাদেশে কি এমনিতেই ঘুরতে আসবে নাকি অন্য কোন কারণ?সাথে সাথে ওর উত্তর পাইনি।ঘুমোতে যাবার আগে আরেকবার চক করতেই দেখলাম ওর রিপ্লাই এসেছে।সেখানে সে লিখেছে আমি বাংলাদেশে আসবো একটি বিশেষ কারণে।শুনেছি বাংলাদেশ আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে,ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে গেছে,নেতা নেত্রীরা এখন নিয়মিত শপিং করতে আমেরিকা কানাডাতে আসছে।কারো কারো পুরো পরিবার দেশের বাইরে রাজার মত বাস করছে কিন্তু টাকা পয়সার কোন অভাব হচ্ছেনা।এর বাইরে আরো কয়েকটা কারণ আছে এই যেমন বাংলাদেশে ঘুরতে গিয়ে অনেক পযর্টক সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করেছে সেগুলি আমাকে আগ্রহী করে তুলেছে।তাছাড়া তুই চলে যাবার পরতো তোর সাথে কখনো দেখা করার সুযোগ হয়নি এটাও একটা কারণ বলতে পারিস। তবে প্রধান কারণ যেটি তা আমি এখনি বলতে চাইনা।এসে তার পর বলবো।

প্রধান কারণ আর জানা হলো না এবং সেটা জানার জন্য মনটা বেশ উদগ্রীব হয়ে থাকলো।সেদিন চোখে আর ঘুম এলো না।দুটো কথা বেশ বার বার ঘুরে ফিরে আসছিল মাথার মধ্যে।প্রথমটি লিন্ডা নিজে বলেছে আর দ্বিতীয়টি মম বলেছে। লিন্ডা বলেছিল ও যাকে পছন্দ করে সে হলো চাঁদের মত যাকে দূর থেকে দেখতে হয়,কল্পনায় ছুতে হয়।চাঁদকে যেমন ছোয়া যায় না ঠিক তেমন।তার মানে সে এমন কারো কথা বলেছে যে তার থেকে অনেক দূরে থাকে তাই ইচ্ছে হলেও তাকে কাছে পাওয়া যায়না,ছোয়া যায়না বরং দূর থেকে দেখতে হয়।আমিওতো অনেক দূরে থাকে যাকে দুর থেকেই দেখতে হয় এবং কল্পনাতেই ছুতে হয়।তবে কি লিন্ডা আমার কথাই বলেছে!নিজেই নিজের মাথায় একটা টোকা দিয়ে বললাম যাহ এসব কেন ভাবছি।আবার মমের কথাটাও মাথায় ঘুরছে।লিন্ডাকেতো সারা জীবনের জন্যও রেখে দেওয়া যায়!তুইকি সারা জীবন একা থাকবি নাকি?তার মানে মম বলতে চাইছে লিন্ডা আর আমার মধ্যে একটি বন্ধন তৈরি হলে সে আমার হয়ে থাকবে।

নিজেকে বেশ পাগল বলে মনে হচ্ছে।আমি যে লিন্ডাকে নিয়ে এসব কথা ভাবছি ও জানতে পারলে কি মনে করবে!তবে চাইলেইতো আর মনের মধ্যে গড়ে ওঠা কল্পনার জাল ছিড়ে ফেলা যায় না।আমিও সেটা ছেড়ার চেষ্টা করিনি।

যথারীতি সাটারডে ইভিনিংএ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটের বিজনেস ক্লাসের যাত্রী হয়ে বাংলাদেশের আলোবাতাসে বেরিয়ে এলো লিন্ডা ওয়াটসন।আমি আর মম আগে থেকেও প্লাকার্ড হাতে রিসিভিং জোনে হাজির ছিলাম।বোর্ডিং পাস হয়ে গেলে লিন্ডা বেরিয়ে এলো।আমাদের কেউ কাউকে চিনতে কোন বেগ পেতে হয়নি কারণ প্রতিনিয়তই আমরা একে অন্যকে ছবিতে দেখি।লিন্ডা আমাকে হাগ করে মমকে জড়িয়ে ধরলো।মমও ওকে এমন ভাবে আগলে নিলো যেন জনম জনমের পরিচয় দুজনের মধ্যে।যেন ওরা দুজন একসাথে বেড়ে উঠেছে,খেলেছে,স্কুলে গিয়েছে।ওর লাগেজ গুলো ভাগাভাগি করে টেনে নিয়ে গাড়িতে চেপে বসলাম।আমি সামনে বসলাম আর মম ওকে নিয়ে পিছনে বসলো।বাসায় যেতে যেতে কত যে কথা হলো।লিন্ডা বাংলাদেশে এসেছে মাত্র কয়েক সপ্তাহ থাকবে বলে।তবে ভালো না লাগলে একসপ্তাহ থেকেও চলে যেতে পারে।কথাটা বলতেই মম বললো আর যদি ভালো লেগে যায় তবেকি তুমি সারা জীবনের জন্য থেকে যাবে?মমের কথাটা ওর মনে ভাবাবেগ তৈরি করলো।লিন্ডা বললো তেমন কিছু হলেতো বেশ মজাই হবে।সামনের লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে একবার ওকে দেখে নিলাম।আগের সব দেখার সাথে এই দেখার কেন যেন কোন মিল নেই!! আশ্চর্য আমি বোধহয় ওকে বেশি করে ফিল করতে শুরু করেছি।

বাসায় ঢুকে ফ্রেশ হয়ে লিন্ডা ওর লাগেজ নিয়ে বসলো।আমেরিকা থেকে আসার সময় কত কিছু যে নিয়ে এসেছে তার কোন হিসেব নেই।আমাদের জন্য এবং আমাদের পরিচিতদের মধ্যে লিন্ডা যাদেরকে চেনে সবার জন্য কিছু না কিছুতো এনেছেই।বাদ পড়েনি জাহিন জামিল ফীহা নোভা মুনা মিফরা কেউ।কারো জন্য চকলেট এনেছে কারো জন্য পুতুল আবার কারো জন্য স্মার্টওয়াচ। যার যেমনটি পছন্দ তাকে তেমন উপহার।মমের জন্য এনেছে দামী কসমেটিক্স আর আমার জন্য কিছু টিশার্ট আর পারফিউম।সবার জন্য আনা উপহার বের করার পরও ওর লাগেজে একটা প্যাকেট ছিল।কাগজ দিয়ে মোড়ানো।আমি বললাম ওটা কি? ও বললো ওটা একটা শাড়ী!!আমেরিকানরাতো শাড়ী পরেই না বলা চলে!!তাহলে শাড়ী কার জন্য?মম বললেন তবেকি তুমি বাংলাদেশের কালচারের সাথে মিশতে চাও বলেই শাড়ী কিনেছ ওটা নিজে পরবে বলে? মমের কথা শুনে লিন্ডা মাথা নেড়ে জানালো নিজে পরার জন্য সে শাড়ীটা কেনেনি!! মমের চেয়েও বেশি অবাক হলাম আমি।তার পর জানতে চাইলাম তাহলে তুমি শাড়ী কেন কিনেছ? কাকে দিবে বলে কিনেছ? এবার ওর মূখটা বেশ মলিন হয়ে গেল।চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো যেনবা তখনি সে কেঁদে ফেলবে।একটা মেয়ে একাকী আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ দেখবে বলে ছুটে এসেছে আর দীর্ঘ ক্লান্তিকর জার্নির পর তাকে বিশ্রান নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে আমরা তার সাথে আড্ডা শুরু করে দিয়েছি এটা বেশ অমানবিক।তবে লিন্ডা নিজে বললো সে ক্লান্ত নয় এবং এখনি তার বিশ্রামের দরকার হচ্ছেনা।তার পর একটু শান্ত হয়ে সে বললো শাড়ীটা সে একজনকে দিবে বলে কিনেছে এবং এই শাড়ীটা দেওয়াটাই বাংলাদেশে আসার প্রধান উদ্দেশ্য!

কেউ একজনকে একটা শাড়ী দেওয়ার জন্য আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আসতে পারে তা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল।তাও যদি এমন হতো যে লিন্ডা নিজে একটি ছেলে এবং সে শাড়ীটা এমন একজন মেয়েকে দিতে চায় যাকে সে ভালোবাসে তাহলেও একটা কথা ছিল কিন্তু লিন্ডা নিজে মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে একটা শাড়ী দেওয়ার জন্য হাজার হাজার ডলার হাতে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে এটা সত্যিই বিস্ময়কর।মম জানতে চাইলো কাকে দেবে শাড়ীটা? লিন্ডা জানালো সে যাকে শাড়ীটা দেবে তাকে সে চেনে না বরং তাকে খুজে নিতে হবে আর এ জন্যই সে বেশ কিছুদিন সময় নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে।ওর কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।যাকে সে একটা শাড়ী দিবে বলে সুদুর আমেরিকা থেকে এসেছে তাকে সে চেনেই না এমনকি তার কোন ঠিকানাও সে জানে না!তাহলে কি করে দেবে সে?কোথায় পাবে তাকে?লিন্ডার সরল জবাব সে তাকে দেশের অলিতে গলিতে খুঁজবে তার পরও সে তাকে খুঁজে বের করবেই।

তখনকার মত আড্ডা শেষ করে লিন্ডাকে ওর রুম দেখিয়ে দেওয়া হলো।মম ওকে সব বুঝিয়ে দিলো।রুমের সাজ সজ্জা দেখে লিন্ডা খুবই অবাক হলো।মম ওটাকে এতো সুন্দর করে সাজিয়েছে যেন মনে হয় স্বপ্নলোক!ডিনার শেষে লিন্ডা সবাইকে ওর রুমে ডাকলো।তার পর ব্যাগ থেকে একটি অ্যালবাম বের করলো এবং সেটা থেকে একটি ছবি বের করলো।সেটি দেখিয়ে বললো এই মানুষটিকে আমি শাড়ী দেব বলে এসেছি।ছবিটার অনেক গুলো কপি করেছে লিন্ডা।একটি ছবি আমার হাতে দিয়ে একটি মমকেও দিলো।মিফরা,ফীহা,ফারহানা ওরাও একটা করে ছবি নিলো।সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসলো।আমি যখন নিজের চোখের পানি আড়াল করতে চেষ্টা করছি তখন লক্ষ্য করলাম অন্য সবার চোখেও পানি এবং সেটা কিছুক্ষণের মধ্যে প্রায় কান্নায় রূপ নিলো।ছবিটি একজন বয়স্ক মহিলার।একটি খোলা মাঠে বাশের বেড়ায় যিনি ভেজা শাড়ী শুকাতে দিয়ে ঠায় দাড়িয়ে আছেন।শাড়ীটা শুকাতে দিয়ে তার যে চলে যাবার কোন উপায় নেই কারণ শাড়ীর অন্য প্রান্ত তখন তার পরণে!তার যে একটি মাত্র শাড়ী যেটি গোসলের পর ভেজা থাকায় রোদে দাড়িয়ে শুকাতে হচ্ছে।একপাশ শুকিয়ে গেলে সে পাশ শরীরে জড়িয়ে নিয়ে অন্য পাশটাও শুকাতে হবে।

এই ছবির মানুষটির কথা ভেবে লিন্ডা সুদুর আমেরিকা থেকে ছুটে এসেছে শাড়ী নিয়ে।আফসোস আমি কেন গেলাম না?আমি কেন অতটা মায়া দেখালাম না?রাতে ঘুমানোর সময় চিন্তা করলাম যে দেশের রাস্তায় কয়েক কোটি টাকা দামের ব্যক্তিগত গাড়ী চলে সে দেশে এমনও মানুষ আছে যাদের ভেজা শাড়ী শুকাতে রোদে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়।একটা শাড়ীর কতইবা দাম?পাঁচশো? এক হাজার?দুই হাজার?বিশেষ করে সাধারণ মানুষ যে শাড়ী পরে তার দামতো পাঁচশোটাকাও না।পরদিন সকালে আমি লিন্ডাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সেই মহিলাকে খুঁজতে।ঢাকার অলিতে গলিতে,বস্তিতে বস্তিতে খুজলাম,মানুষকে ছবি দেখালাম কিন্তু কেউ বলতে পারলো না।এক সপ্তাহ ঘুরে পুরো ঢাকা দেখা শেষ হলে গেলাম ঢাকার বাইরে।সাভারে গিয়ে ছবিটা দেখাতেই অনেকেই চিনলো।তারা আমাদেরকে এলাকার নাম বলতেই আমরা ছুটে চললাম সেদিকে।পথে একটি দোকান থেকে আরো বেশ কয়েকটি শাড়ী কিনলো লিন্ডা।একসাথে অনেক গুলো শাড়ী হলে সেই মানুষটি আগামী কয়েক বছর নিশ্চিন্তে পরতে পারবে এটাই ছিল লিন্ডার চিন্তা।ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।অবশেষে পাওয়া যাচ্ছে সেই মহিলাকে যাকে সে শাড়ী দিতে ছুটে এসেছে সুদুর আমেরিকা থেকে।

পথে একটি মাঠ পেরোতে হয়।যে মাঠের ছবি ছিল সেই ছবিটাতে যেখানে মহিলা শাড়ী শুকাচ্ছিল।দূর থেকে সেই বাশের বেড়াটিও দেখা গেল।তবে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সেই বেড়ার উপর কি যেন লাগানো।আমাদের গাড়ীটা যতই কাছে আসছিল ততো স্পষ্ট হচ্ছিল।এবং একসময় দেখলাম ওটা একটি শাড়ী!লিন্ডার চোখটা ছলছল করে উঠলো।ব্যাগ থেকে ছবিটা বের করে মেলে ধরতেই চোখটা প্রায় ঝাপসা হয়ে এলো পানিতে।এই শাড়ীটাতো সেই শাড়ী যেটা মহিলাম পরে ছিলেন এবং একটা পাশ রোদে শুকাতে দিয়েছিলেন।হঠাৎই লিন্ডার মনটা খারা হয়ে গেল।সে যাকে শাড়ী দিতে এসেছে তার বোধহয় এখন আর শাড়ীর প্রয়োজন নেই।নিশ্চই তাকে কেউ নতুন কাপড় কিনে দিয়েছে তা না হলে এই শাড়ীটা এখানে থাকতো না।আমি বললাম সেটা হলেতো ভালো হয়।তুমি যার দুঃখ দূর করতে ছুটে এসেছো তাকে সুখী দেখলে তোমারতো আনন্দিত হওয়া উচিত।আমার কথাটা লিন্ডার কাছে বেশ যুক্তিযু্ক্ত মনে হওয়ায় চোখের পানি মুছে ফেললো।তবে ড্রাইভারকে বলে গাড়ী থামিয়ে সে নেমে পড়লো।তার পর বাশের বেড়ার উপর রাখা শাড়ীটাতে সে হাত বুলাতে লাগলো। এভাবে কিছুক্ষণ পার হওয়ার পর আমরা আবার রওনা হলাম।লিন্ডার চেহারায় আগের মত দুশ্চিন্তার ছাপ নেই।সে বোধহয় মহিলার সুখী হওয়াতে খুবই আনন্দিত হয়েছে।সেই আবাসিক এলাকাতে প্রবেশ করতেই একজনের সাথে দেখা।গাড়ী থামিয়ে তাকে ছবিটা দেখাতেই তিনি যা বললেন তাতে লিন্ডার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।লাস্ট সাটারডেতে যখন লিন্ডা আমেরিকা থেকে রওনা দিয়েছে তারও এক সপ্তাহ আগে মহিলা মারা গেছেন!লিন্ডার হাতে ধরে রাখা শাড়ীটা ছুটে পড়ে গেল।আমি সেটা উঠিয়ে ওর হাতে দিয়ে ওকে শক্ত করে ধরলাম।বুঝলাম কেন আসার সময় মহিলার সেই শাড়ীটাকে বেড়াতে লাগানো দেখেছিলাম।সত্যিইতো তার আর ওই শাড়ীর কোন দরকার নেই।তাকে সবাই মিলে নতুন কাপড় কিনে দিয়েছে। সে এখন অনেক সুখে আছে।তারতো আর ওই পুরোনো শাড়ীর কোন দরকার নেই।লিন্ডা একটি শাড়ী কিনেছিল সেই শাড়ীটা যার জন্য কিনেছিল তাকে দেওয়া হলো না।ফেরার পথে সে শাড়ীটাকে আগে নেড়ে দেওয়া শাড়ীটার উপর ঝুলিয়ে দিলো।ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হলো।আকাশে তখন ভরা পুর্ণিমার চাঁদ।চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে পড়লো লিন্ডার সেই কথাটি।চাঁদের মতও কোন কোন মানুষ হয় যাদেরকে ধরা যায়না,ছোয়া যায়না বরং সরে যেতে থাকে।দুদিন পর ফিরতি ফ্লাইটে লিন্ডা ফিরে গেল আমেরিকাতে।জীবনে আর কোন দিন লিন্ডা শাড়ী কেনেনি।এমনকি আমাদের বিয়ের দিনেও সে শাড়ী পরেনি।

১৭ মার্চ ২০১৮