বাড়ি যাচ্ছি। কাঁধে ছোট্ট একটি ব্যাগ,ভিতরে বলার মত তেমন কিছু আছে বলে মনে পড়ছে না। আইডি কার্ডটা যদি বলার মত কিছুর তালিকায় ধরা হয় তাহলে অবশ্য বলার মত ঐ আইডি কার্ডটাই আছে। তবে ঐ আইডি কার্ডের তেমন কোন মূল্য নেই। ওটা দেখালে রেশনও পাওয়া যাবে না আবার মাংনাও কোথাও যাওয়া যাবে না।আমার ব্যাগের মধ্যে এখন ওটা একটা জঞ্জাল ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে দুটো সময়ে ওটার কিছুটা মূল্য বুঝা যায়। যখন আমি কাজে ঢুকি তখন গলার সাথে ওটা ঝোলানো না থাকলে কোন ভাবেই ঢুকতে পারিনা। আর দ্বিতীয় কারণটা অবশ্য আরো কঠিন।আমি বেওয়ারিশ হয়ে যাওয়ার অপবাদ থেকে কেবলমাত্র ওটাই আমাকে সাহায্য করতে পারে।
রাস্তার যে অবস্থা আর যা দিনকাল পড়েছে তাতে যে কোন সময় ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। আর পথে ঘাটে ওরকম কিছু ঘটে গেলে আইডি কার্ডটাই ভরসা। অন্তত কারো মনে দয়া হলে চাঁদাটাদা তুলে আমার অচেতন দেহটাকে পরিবারের কাছে পৌছে দিলে তারা দু’চারদিন কাঁদার মত একটা উপলক্ষ্য পাবে।আর যদি বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন করে দেওয়া হয় তাহলে পরিবারের লোকেরা ভাববে আমি বোধহয় আরেকটা বিয়ে করে সেই সংসারে এতোটাই মজে আছি যে, পরিবারের কথা ভুলেই গেছি। তাদের ভাবনাটা অবশ্য একদম মিধ্যে হবে না। আমি মারা গেলে আমারতো আরেকটা সংসারই হবে। মাটির ছোট্ট ঘরটি তখন আমার বাড়ি বলে ধরে নেওয়া যাবে।
মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে আইডি কার্ড না থাকলেও পরিচয় বের করা কঠিন কিছু নয় এমন যুক্তি অবশ্য অনেকেই দিতে পারেন। সাভারের রানাপ্লাজায় যারা মারা গিয়েছিল তাদের সবার কাছেই মোবাইল ছিল কিন্তু লাশ উদ্ধারের পর সেই মোবাইলগুলো কিভাবে যেন হাওয়া হয়ে গেল। ফলে অনেকের আইডি কার্ড এবং মোবাইল কোনটাই না পাওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে দেওয়া হলো।সুতরাং আমি মারা গেলে আমার পকেট থেকেও মোবাইলটা যে হাওয়া হয়ে যাবে না তার নিশ্চয়তাইবা আমি কি করে দেব?কিংবা এই নিশ্চয়তাইবা কে আমাকে দেবে।আর সে জন্যই আপাত দৃষ্টিতে বিশ্ব ব্যাংকের সিইও না হয়ে ও জঞ্জাল আইডি কার্ডটা ব্যাগেই রেখেছি। নিজের বেওয়ারিশ সমাধস্থ হওয়ার ভয়ে নয় বরং পরিবারকে দু’চারদিন কান্নার উপলক্ষ্য দেওয়ার জন্য ওটা সাথে রাখা।আর তাছাড়া ফিরে এসে কাজে যোগ দিতে হলেওতো ওটা লাগবে। ব্যাগের সবচেয়ে ছোট পকেটে একটা ব্রাশ আর পেষ্টও আছে।
ষ্টিশানরোড ওভার ব্রিজের ওপর থেকে দশটাকা দিয়ে ব্রাশটা কিনেছিলাম সে বছর দু’য়েক আগে। ব্রাশের মাথাটা বয়সের ভারে বেকে গেছে কিন্তু এতো দিন যে আমার সংসারে ছিল সে বৃদ্ধ হয়ে গেছে বলেতো আর তাকে ফেলে দিতে পারি না। বড়লোকদের কথা বাপু আলাদা। ডাক্তার বলেন ব্রাশ নাকি তিন মাসের বেশি ব্যবহার করা যাবেনা।ফলে তিন মাস পর তারা ব্রাশটাকে ফেলে দেয়। ঠিক যেমন একটা বয়সে বাবা মাকে ফেলে দেয় পুরোনো ভেবে। পুরোনো হয়ে যাওয়া ব্রাশটা ডাষ্টবিনে ফেলে দেওয়া আর বৃদ্ধ বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা সমান কথা।স্টিশানরোড ওভারব্রিজের উপর থেকে যে ব্রাশটা আমার পরিবারে ঠাই নিয়েছিল বছর দুয়েক আগে আমি তাকে বৃদ্ধ পুরোনো ভেবেও তাই ফেলে দেইনি।ভয় হয় আজ যদি ব্রাশটা পুরোনো ভেবে ফেলে দেই কাল হয়তো বাবা মাকেও পুরোনো ভেবে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবো।
ব্রাশের সাথে একটা পেষ্টও আছে ব্যাগের ছোট পকেটে।পেষ্ট বলতে ঠিক যা বুঝায় এটা সেরকম নয়। ওটার কথা তাই না বলাই ভাল। একটি লুঙ্গি আর একটি গামছাও আছে। ছুটির দিন গুলিতে গোসলের সময় আমি কখনো লুঙ্গি ভিজতে দেইনা। লুঙ্গিটা ভেজালে পরার মত তেমন কিছু থাকবেনা। মেস ঘরের দরজাটা একদিন আমার সাথে শত্রুতা করলো। যখন দোকানে যাব বলে বের হচ্ছি তখন দরজাটা আমাকে থামিয়ে দিল। আমি যদিও শুনতে পাইনি তবে দরজাটা নিশ্চই গান ধরেছিল ‘যেওনা সাথী আমার চলেছ একেলা কোথায়’। সে গানটা নিশ্চই আমার জন্য নয় বরং আমার লুঙ্গিটার জন্য।
আমি শুনতে না পেয়ে যখন জোর করে বের হয়েছি তখন লুঙ্গি আর দরজার হাত ছুটে গেল এবং একটা শব্দ শুনতে পেয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি লুঙ্গির একটা অংশ ছিড়ে গেছে।মেজাজ খারাপ করে লাভ নেই ভেবে দোকান থেকে সুঁই সুতা কিনে ঘরে বসে নিজেই সেলাই করে নিলাম।ক’টা টাকা গচ্ছা গেল ভেবে বেশ মনখারাপ হল। ব্যাগের ভিতরে একটা পুরোনো পাঞ্জাবী আছে। ঈদে বাড়ি যাচ্ছি, পাঞ্জাবী ছাড়া ঈদগাহে যাওয়াটা বেশ অস্বস্তিকর হবে ভেবে বউবাজার থেকে পাঞ্জাবীটা কিনে এনে টানা দুই ঘন্টা হুইল পাউডারে ভিজিয়ে রেখেছিলাম। ধুয়ে শুকানোর পর সেটা লন্ড্রিতে দেওয়া হয়নি।পাঁচ টাকা খরচ করে পাঞ্জাবী লন্ড্রি করা আমার কাছে শ্রেফ বিলাসীতা ছাড়া কিছুই নয়। তার চেয়ে বরং ভাজ করে তিনদিন বালিশের নিচেয় চাপা দিয়ে রাখলাম এবং আসার সময় বের করে আনতে গিয়ে বেশ পরিতৃপ্ত হলাম। চমৎকার ভাজ হয়েছে। বিদ্যুৎ ছাড়া বিনা খরচে লন্ড্রি করাটা বেশ আনন্দের।
বাড়ি যাচ্ছি ঈদের ছুটিতে। আর কিছু পাই না পাই বেশ লম্বা ছুটি পেয়েছি। ছুটি শেষে যখন ফিরে আসবো তখনকার অবস্থা কল্পনা করতেও ভয় পাই। বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করে বেরিয়েছি। রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম। একটি তালি দেওয়া লুঙ্গি,কোনা ছিড়ে যাওয়া একটি গামছা,দু’বছর বয়সী মাথা বেকে যাওয়া ব্রাশ আর একটুখানি পেষ্ট ছাড়া বলার মত তেমন কিছু ছিলনা ব্যাগের মধ্যে। একটি চিরুনী অবশ্য থাকতে পারতো তবে দু’টো হাতে যেখানে দশটা আঙ্গুল আছে সেখানে চুল আচড়ানোর জন্য চিরুনী কিনলে নিজেকে সম্রাট শাহজাহান মনে হবে।নিজেই যদি সম্রাট শাহজাহান হয়ে বসে থাকি তবে বাড়িতে যাকে রেখে এসেছি তিনিতো মমতাজ হতে চাইবেন।
চিরুনীর সাথে আয়নাটাও প্রাসঙ্গিক। তবে আয়নাও কেনা হয়নি। আয়নায় দেখার মত মূখই যদি না থাকে তাহলে আয়না কিনে লাভ কি?বাড়িতে গেলে অবশ্য আয়নার অভাব হয় না। একটা ছোট আয়নার পাশাপাশি একটা বড় আয়নাও আছে। বড় আয়নার সাথে ছোট আয়নাটা ফ্রিতে পাওয়া। আয়নাটা এতোই ছোট যে পুরো মূখটা একবারে দেখা যায় না। আর বড় আয়নাতে শুধু মূখ নয় পুরো আমাকেই দেখা যায়। বাজার থেকে কেনা আয়নায় মূখ দেখা না গেলেও আমার আয়না আমাকে দেখেই আমার সম্পর্কে সব বলে দিতে পারে। কথা বলা আয়নায় মূখ দেখা হয়েছে জীবনে একবার তার পর কেবলই কথাই শুনতে হচ্ছে।
ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে আনারকলি থেকে বেরিয়ছি, যেতে হবে আব্দুল্লাহপুর। এটুকু পথ রিকশাতে গেলে বেশ দ্রুতই যাওয়া যায়। আমি দেখেছি মানুষ যখন রাস্তায় বের হয় তখন রিকশাওয়ালারাই ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করে মামা কই যাবেন। আমাকে কখনো কোন রিকশাওয়ালা ডেকে জানতে চায়নি আমি কোথায় যাব। আজকে একটু তাড়া ছিল। ভাবলাম রিকশা করে আব্দুল্লাহপুর যাই।যদিও মাত্র পাঁচ টাকা খরচ করবোনা ভেবে পাঞ্জাবী লন্ড্রিতে দেইনি কিন্তু তাড়া বলে কথা, তাই রিকশা চড়ার বিষয়ে কোন ছাড় না দিলেও চলবে। পরপর তিনজন রিকশা ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম যাবে কিনা।তারা আমার কথার জবাবই দিল না। ভাবলাম মামা বলে ডেকেছি বলে হয়তো কথার উত্তর দেয়নি। চতুর্থজনকে বললাম ভাই যাবেন। কিন্তু সেও জবাব দিল না। মন খারাপ হোক বা না হোক মেজাজ খারাপ হওয়ার কথা কিন্তু আমার মেজাজ খারাপ হল না। হতে পারে মেজাজ বলতে আমার মধ্যে এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। পঞ্চম রিকশাওয়ালা কথা বললো। তবে তার কথাও আশা ব্যাঞ্জক নয়। সে ত্রিশ টাকা ভাড়া চেয়েছিল আমি তাকে দশটাকা দিতে চাইলাম।তাতেই সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।যেতে যেতে তার মূখ থেকে শুধু একটি কথাই শুনতে পেলাম ‘ছোটলোক’।কথাটা আমাকেই বলা হল কিন্তু আমার গায়ে লাগলো না। গরুকে মানুষ যখন গরু বলে ডাকে কিংবা কুকুরকে যদি কুকুর বলে ডাকে তাহলে তাদের গায়ে লাগার কথা নয়। মানুষকে কখনো গরু বা কুকুর বললে সেটা গালি দেওয়া হয় তাই গায়ে লাগে। কিন্তু ছোটলোককে ছোটলোক বললে তাই গায়ে লাগার কথাও নয়। আমাকে ছোটলোক বলে সে হয়তো তৃপ্তি পেয়েছে তবে আমার লাখটাকার ক্ষতিতো হয়নি।
রিকশাওয়ালা দশটাকায় যেতে রাজি না হওয়ায় আমার বরং লাভ হল।যে টাকাটা রিকশা ভাড়া দিতে হত সেটা বেচে গেল। বুক পকেটে হাত দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে মধুমিতা থেকে আনারকলি রোড ধরে হাটতে হাটতে আব্দুল্লাহপুরের দিকে এগোতে থাকি। সারা রাস্তায় মানুষের ঢল। বাড়ি যাচ্ছি, কাঁধে ছোট্ট একটি ব্যাগ কিন্তু মনে হচ্ছে গোটা শহরটাকে, শহরের মানুষগুলোকেই সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি। ক্লাস এইটের বিজ্ঞান বইয়ে গ্রহ নক্ষত্রের কথা পড়েছিলাম। সুযর্কে কেন্দ্র করে ঘুরছে পৃথিবীর মত আরো অনেক গুলো গ্রহ। বাড়ি ফেরার সময় চারদিকে এতো মানুষ দেখছি নিজেকে একটি নক্ষত্র মনে হচ্ছে। যাকে ঘিরে গ্রহের মত আবর্তন করছে হাজার হাজার মানুষ।যদিও তারা তাদের বাড়িতে যাচ্ছে কিন্তু ক্ষণিক সময়ের জন্য আমার মন ভাবতে ভালবাসছে যে তারা আসলে আমাকে ঘিরে আবর্তন করছে।
যে বাসের জানালা খোলা যায় না সে বাসের কথা থাক বরং যে সব বাসের সিট কিছুটা বাঁকানো যায় সে সব বাসের কথাও কখনো কল্পনা করতে পারি না। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি মানুষের সমুদ্র।চারদিকে মানুষ আর মানুষ কিন্তু কোন বাস নেই। কেউ কেউ বেশ নিবির্কার। হয়তো তাদের আগে থেকেই টিকেট করা আছে তাই অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে। একটা দুধের শিশু মায়ের আঁচলের তলে মূখ লুকিয়ে পৃথিবীর সব উত্তেজনা বিরক্তিকে পাশ কাটিয়ে আরাম করে চুকচুক করে ক্ষুধা নিবারণ করছে। পাঁচ বছরের বাচ্চা একটি ছেলে বাবার হাত ধরে কোথাও যাওয়ার জন্য টানাটানি করছে। বাবা যেতে চাইছেনা দেখে তার চোখে মূখে বিরক্তির ছাপ। ঝালমুড়িওয়ালা,শরবতওয়ালা আর বাদামওয়ালাদের কপাল দিয়ে ঘাম ঝরলেও মনে দারুণ খুশি। বেচা কেনা চলছে হরদম।
বাসস্ট্যান্ডের উত্তরে তুরাগ নদীর তীরে যে ফিলিং স্টেশান তার দোতলার বিশাল এরিয়া নিয়ে একটা হোটেল করা হয়েছে। চারদিকে উপচেপড়া ভীড় থাকলেও হোটেলটা পুরো ফাঁকা।পেটে ক্ষুধা থাকলেও সম্ভবত কেউ ভারি খাবার খাওয়ার পক্ষে নয়।হোটেল বেয়ারাকে দেখা যাচ্ছে রেলিং ধরে দাড়িয়ে ভীড়ের দিকে চাতকের মত চেয়ে আছে।নির্ধারিত বেতনের চাকরি করলেও বেয়ারাও চায় হোটেলে লোকজন আসুক। তাতে দু’দশটাকা বকশিস পেলে সেটা অনেক।
লোকজনের কাঁধে,পিঠে,হাতে ব্যাগ, গাট্টিবোচকা।কোন কোনটা ঢাউস সাইজের। দেখে কল্পনাও করা যায় না তার মাঝে কি এমন জিনিষ আছে। বাক্সপেটরার বহর দেখে মনে হয় লোকগুলো আজীবনের জন্য যান্ত্রিক এই শহরের মায়া কাটিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে। যা টেনে নিয়ে যাচ্ছে তা যদি আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হয় তাহলে এই অযথা ধকলের দরকার কি!আমার সাথে কাঁধে ঝোলানো দুইকেজি ওজনের ব্যাগটা ছাড়া কিছু নেই।টুকটাক কিছু কিনতে হলে নিজের শহরে নেমেই কেনা যাবে, তাতে করে বোঝা বহনের কষ্টটা বেঁচে যাবে।
একজনের হাতে একটা সিলিং ফ্যান।বাড়িতে গিয়ে আরামে বাতাস খাবে চিন্তা করেই হয়তো ফ্যানটা সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে।আমি ভাবছি যারা বাড়িতে আছে তারাকি তাহলে কারেন্ট থাকার পরও ফ্যান ছাড়াই থাকে?নাকি এমন হতে পারে তাদের ঘরে ফ্যান আছে কিন্তু যিনি বাড়িতে যাবেন তার থাকার ঘরে কোন ফ্যান নেই ভেবেই নিয়ে যাচ্ছেন। আরেকজন সাথে করে একটা টিভি নিয়ে যাচ্ছে। হতে পারে বাড়ির জন্যই কিনেছেন। একটা টেলিভিশনের শখ আমারও ছিল। মেয়েটা পাশের বাড়ি গিয়ে মাঝে মাঝে টিভি দেখে। কখনো কখনো অসময়ে তারা টিভি বন্ধ করে দিলে মেয়েটা মনখারাপ করে ফিরে আসে।আমাকে একদিন সে বললো বাবা একটা টিভি কিনতে কত টাকা লাগে। এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণা ছিলনা তবে তাকে বললাম সে তো বেশ কিছু টাকা লাগবেই। সেদিন থেকে সে মাটির ব্যাংকে টাকা জমাতে শুরু করেছে। তার একটা টিভির খুব শখ। লোকটার হাতে টিভিটা দেখে কথাটা মনে পড়ে গেল।
মাঝে মাঝে পুলিশের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। তখন একটা কি দুটো বাস মানুষের ভীড় ঠেলে বেরিয়ে যাচ্ছে। দরজা জানালা সব বন্ধ। পেট্রোল পাম্পের পাশে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে একটা মিনিবাস আসলো। ভাড়া জিজ্ঞেস করার মত সুযোগ পেলাম না তার আগেই দেখি পুরো বাস কানায় কানায় ঠাসা। ভাড়া জেনে বাসে ওঠার আশায় গুড়ে বালি। এক যাত্রীর কাছে জানতে পারলাম নবিনগর পযর্ন্ত ভাড়া একশো টাকা। গত সপ্তাহে যখন গেলাম তখন ভাড়া ছিল ত্রিশ টাকা আর এখন সেটা একশোতে ঠেকেছে।চাকরি করি,মাস গেলে বেতন পাই,ঈদের সময় দু’চার টাকা বেশি ভাড়া না দিলে কি চলে? এসবই বাসওয়ালাদের চিন্তা ভাবনা।আমি বোনাস পেয়েছি মাত্র একবার, একজনের কাছ থেকে। তার পর ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়া অব্দি আমাকে বোনাস দিতে হবে দশবার।চাকরিজীবীকে বাড়ি ফিরতে দেখলে লোকে মনে করে সে বুঝি টাকার বস্তা নিয়ে বাড়ি ফিরছে।
তিরতির করে ঘামছি।বাস কখন পাব জানি না। হাটাহাটি করে ক্ষুধাও লেগেছে বেশ।ঝালমুড়ি ঝালমুড়ি বলে যে লোকটা সমানে চেচাচ্ছিল আমি তাকে কাছে ডেকে বললাম পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি দিন। সে আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন দিনের বেলায় সে ভূত দেখছে। তার পর বললো পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি হয় না।কমপক্ষে দশটাকার নিতে হবে। আমি বললাম যান লাগবেনা। আমি শুনতে পেলাম সে বিড়বিড় করে বলছে ছোটলোক। আমি তাকে ধরতে পারতাম কিন্তু কোন ইচ্ছেই হয়নি। ছোটলোক বলায় আমারতো আর জাত চলে যাচ্ছেনা।
মুড়ি খাওয়ার ইচ্ছেটা মাঠে মারা গেল। আমার মত আরেকজন ছোটলোকের দেখা পেলে দু’জনে মিলে দশটাকার মুড়ি কিনে খাওয়া যেত। পকেটে হাত দিয়ে একটা পাঁচটাকার নোট বের করে অন্য পকেটে রেখে দিলাম। মেয়েটার জন্য যদি একটা টিভি কেনা যায়। এমনিতেতো টাকা জমাতে পারিনা তাই যখন রিকশা ভাড়া বনিবনা না হলে হেটে যাই তখন ঐ টাকাটা আলাদা করে রাখি। যখন ঝালমুড়ি বা অন্য কিছু খেতে গিয়ে কোন কারণে খাওয়া হয়না তখন সেটাও আলাদা করে রাখি। মেয়ের মা টিটকারি মেরে বলে তোমার যতসব ছোটলোকি কারবার। ছোটলোক কথাটা একটা বোর্ডে লিখে গলায় ঝুলিয়ে রাখার মত নামডাক আমার হয়ে গেছে।
দিনে কতবার যে ছোটলোক কথাটা শুনি তা হিসেবের বাইরে। ছোটলোক বলার কারণে যদি প্রত্যেকের কাছ থেকে পাঁচ টাকা করে জরিমানা আদায় করা যেত তাহলে বোধহয় এতোদনে মেয়ের জন্য একটা টিভি কিনে ফেলতে পারতাম।
বাসের ভাড়া শুনে মাথার মধ্যে চক্কর দিতে শুরু করলো। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আর কারো মাথা চক্কর দিচ্ছে না। ভাড়া যাই হোক সবাই বাস আসলেই হুড়মুড় করে উঠে বসছে। হয়তো সিটে বসে দেখছে পা ঢুকছেনা, নয়তো জানালায় কাঁচ নেই।বৃষ্টি আসলে কাক ভেজা ভিজে যেতে হবে জেনেও তাদের মূখে প্রশান্তির ছায়া। বাসে যে উঠতে পেরেছে এটাই যেন বড় ভাগ্যের ব্যাপার। হেটে যাওয়ার মত দূরত্ব হলে আমি হয়তো হেটেই চলে যেতাম।কিছু একটা খাওয়া দরকার কিন্তু বাজেটের সাথে মিলিয়ে তেমন কিছু পাচ্ছিনা। হঠাৎ দেখলাম আমড়া আমড়া বলে একটা বাচ্চা ছেলে চেচাচ্ছে। ভাবলাম পাঁচ টাকায় কিছু পাই বা না পাই অন্তত একটা আমড়া পাওয়া যাবে। ছেলেটা কাছে আসতেই জানতে চাইলাম তোমার আমড়া কত করে। শুনলাম আজ আর আমড়াও পাঁচ টাকায় পাওয়া যায় না।ডিম যেমন শহরের হাওয়া লেগে, তেলের ছ্যাকা পেয়ে মামলেট হয়ে গেছে তেমনি পাঁচ টাকার আমড়া ঈদের বাতাস লেগে দশটাকা হয়ে গেছে। এই ছেলেটি অবশ্য আমাকে ছোট লোক বলেনি। সম্ভবত ঐ কথাটা বলার মত বয়স এখনো হয়নি ওর।
দেড় ঘন্টা দাড়িয়ে থেকে অবশেষে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি বলতে একটা ট্রাক। মেঝেতে ত্রিপল বিছিয়ে বসার মত সুন্দর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৃষ্টি হলে কাক ভেজা ভিজতে হবে এরকম সম্ভাবনার কথা ভেবে উপরে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুরতাং আকাশ দেখতে দেখতে যাওয়ার সুযোগ নেই। পাটুরিয়া ফেরী ঘাট পযর্ন্ত যেতে হবে। বাসে ভাড়া চাচ্ছিল তিনশো টাকা শেষে এই ট্রাকে দেড়শো টাকায় দফারফা করা হলো। হয়তো গতকাল কিংবা তার আগের দিন এই ট্রাকে করে কোরবানীর গরু এসেছিল ঢাকাতে। আর আজ সেই ট্রাকে আমরা ফিরছি,আমরা মানুষ কেউ কেউ আমাদের নাম দিয়েছে ছোটলোক।
রংধনুর যেমন অনেকগুলো রং থাকে তেমনি সমাজে অনেক গুলো স্তর থাকে।আমরা যখন দেড়শো টাকা ভাড়ায় ট্রাকে করে ফিরছি তখন কেউ কেউ আমাদের সারা মাসের মাইনের সমানটাকা খরচ করে ঘরে ফিরছে। কেউ নিজের গাড়ীতে যাচ্ছে,কেউবা প্লেনে যাচ্ছে আবার কেউবা এসি গাড়িতে যাচ্ছে। আর আমরা যাচ্ছি ট্রাকে। ট্রাকের চারপাশে দেয়ালের মত উচু। উপরে ভারি ত্রিপলের ছাউনি থাকায় ভিতরটা গুমোট গরম আর নিস্তব্ধ অন্ধকার। অনেক গুলো মানুষ একসাথে না থাকলে কবরের অন্ধকারের সাথে তুলনা করা যেত। এক পাশে বসে ঝিমুচ্ছে আমারই বয়সী একজন। পরিচিত দুএকজনকে পেয়ে কেউ কেউ খোশ গল্পে মেতে আছে।তাদের এ যাত্রাটা বেশ আনন্দপুর্ন হবে বলেই ধরে নিয়েছি। এখানে যারা আছে তারা সবই এক কাতারের। আমার মত সবাই হয়তো জাবের এন্ড জুবায়েরে কাজ করে না তবে অন্য কোন না কোন গামের্ন্টসে নিশ্চই কাজ করে।কেউ কেউ হয়তো হোটেলে বেয়ারার কাজ করে, কেউবা বাসের হেল্পার-কন্ডাক্টর। এ শহরে কত মানুষ, তাদের হাজারটা পেশা।
আমি নিটিং হেলপার।প্রতিনিয়ত নিটিং সুপারভাইজার থেকে আরো খানিকটা কাজ শিখতে চেষ্টা করছি।যদি নিজে একটু একটু করে এগোতে এগোতে সুপারভাইজার হতে পারি সে আশা আমার মনেও আছে।ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি বাবা মা স্ত্রী সন্তানের সাথে ঈদ কাটাবো বলে। বদ্ধ ট্রাকে প্রচন্ড গরমে ঘামছি। হঠাৎ দেখলাম একজন গাট্টিবোচকা থেকে একটা চার্জার ফ্যান বের করে সেই বাতাসে আরাম পাচ্ছে।আমার অবশ্য দেখা ছাড়া উপায় নেই। ট্রাকের প্রচন্ড শব্দের মধ্যেও ক্লান্তিতে দুচোখে ঘুম নেমে আসছে।ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে দেখতে পাই এক একটি দ্রুতগামী বাস আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে।
ট্রাকের পাটাতনে বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানা নেই।ঘুমের মধ্যে অনেক রকম স্বপ্ন দেখেছি।হঠাৎ মানুষের চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভাংলো।প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি কি হয়েছে পরে বুঝলাম আমরা পাটুরিয়া ঘাটে চলে এসেছি। এই ঘাট পার হয়ে আমাকে যেতে হবে অনেক দূর। যশোরের ঝিকরগাছায়, ওখানেই আমাদের বাড়ি। বাড়ি বলতে ঠিক যা বুঝায় সেরকম নয়।একটা ছনের ঘরে তিনটা রুম।একটাতে বাবা মা থাকে একটাতে আমি স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে থাকি আরেকটাতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা। একটা ছোট রান্নাঘরও আছে খাওয়াদাওয়া সব সেখানেই সারি। ফেরী ঘাটে নেমে মানুষের আরেকদফা ঢল দেখলাম।
ফেরীর টিকেট কাটতে হবে।টিকেট বিক্রেতারা জায়গায় জায়গায় দাড়িয়ে আছে আর তাদের ঘিরে ঘরে ফেরা মানুষের জটলা। অপেক্ষাকৃত কম ভীড় দেখে একজনের কাছ থেকে টিকেট কিনলাম। পঁচিশ টাকার টিকেট বিক্রি হচ্ছে পয়ত্রিশ টাকায়। বুঝাই যাচ্ছে মানুষের এখন বেশ টাকা হয়েছে তাই টিকেটের গায়ে পঁচিশ টাকা লেখা দেখার পরও কারো মনে প্রশ্ন নেই কেন দশটাকা অতিরিক্ত দিতে হবে।আমার অত টাকা হয়নি,আমি পকেট থেকে পঁচিশটাকা বের করে লোকটার হাতে ধরিয়ে দিলাম। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম লোকটা প্রতিবাদ করলো না। আমি শুধু বলেছিলাম টিকেটের গায়েতো পঁচিশ টাকা লেখা । সে সম্ভবত একজন কাষ্টমারের পিছনে অনেক সময় না দিয়ে বরং বাকিদের কথা ভেবে আর কথা বাড়ায়নি।
টিকেট হাতে নিয়ে ফেরী ঘাটের কিনারে গিয়ে দাড়াই। গাড়ি ওঠা নামার জন্য দুটো আলাদা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। দুই রাস্তার মাঝখানে ফাঁকা এবং সেটা দিয়ে নিচের পানি দেখা যায়। তখন বেশ রাত সুতরাং অালো আধারিতে বিষয়টি খুব একটা চোখে পড়েনা।সুবিধামত যায়গায় দাড়িয়ে ভাবছি এই ফেরীতে উঠতে পারবোতো!যে পরিমান মানুষ ভীড় করেছে তাতে তিল ধারনের ঠাই হবে কিনা সন্দেহ আছে। যেহেতু আমার সাথে বড় কোন গাট্টিবোচকা নেই তাই সুবিধামত যায়গায় দাড়ালাম যেন ঠেলেঠুলে উঠতে পারি। এর মাঝে হঠাৎ সোরগোল শুনে এগিয়ে গেলাম।একটা দুধের বাচ্চা পাটাতনের উপর পড়ে আছে আর তার হতভাগা মা দুই পাটাতনের মাঝের ফাঁকা যায়গাতে পড়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। মহিলাকে টেনে তোলা হল আর একজন বাচ্চাটাকে উঠিয়ে কোলে নিল। বাচ্চাটা তখন সমানে কাঁদছে।
ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে মা তার সন্তানের খোঁজ করছে।মা তাহলে এমনই হয়! নিজের কষ্টকে চাপা দিয়ে সন্তানের কথা ভাবে। আকাশে তখন আধখানা চাঁদ।চাদেঁর মৃদু আলো নদীর পানিতে অন্যরকম মোহনীয় দৃশ্য সৃষ্টি করেছে।লঞ্চ ঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছে তার সাইরেনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমার বুদ্ধি নিম্নস্তরের ।অফিসে রাস্তায় এ কথাটা বার কয়েক শুনতে হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করার চেয়ে নিরবে শুনে যাওয়াই ভাল।তবে আজ আমি কিছুটা বুদ্ধিমানের পরিচয় দিয়েছি।সবাই যখন ঐ ফেরী ঘাটে ভীড় করেছে এবং সেখানে তিল ধারনের ঠাই নেই আমি তখন ভীড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে উল্টোদিকে হাটতে শুরু করি। দেখে মনে হতে পারে সদ্য ঘাটে নোঙ্গর করা ফেরীতে আমি ওপার থেকে এপারে এসেছি।
আমি লক্ষ্য করে দেখলাম এক নাম্বার ঘাটে ভিড়েছে খান জাহান আলী ফেরীটি। ওদিকটা অনেকটাই নির্জন। সবাই যখন দুই নাম্বার ফেরী ঘাটে মৌমাছির ঝাকের মত গিজগিজ করে ভীড় করে আছে আমি তখন এক নাম্বার ঘাটে দাড়িয়ে থাকা খান জাহান আলীতে উঠে হাত মুখ ধুয়ে ছাদে গিয়ে বসি।ফুরফুরে বাতাস আমাকে মুগ্ধ করে,শীতলতা এনে দেয় আমার সারা শরীরে।পুরো ফেরীতে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ আর যারা গাড়িতে ছিল তারা। অথচ দুইনাম্বার ঘাটে যে সব ফেরী এসে ভীড়ছে তাতে মানুষের এতো ভীড় যে ঠিকমত দাড়ানোর জায়গা থাকছেনা।
মধ্যরাত। আকাশে আধখানা চাঁদ আলো দিয়ে পরিবেশটাকে মোহনীয় করে রেখেছে। যতদূর চোখ যায় কেবল জোছনার স্রোত। পদ্মার ঢেউগুলো জোছনার ঢেউ হয়ে উঠেছে।ফেরীর ছাদে নামাজের যায়গা আছে।কয়েকজন ধর্মপ্রান মানুষ সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনায় নিজেদের মত্ত রেখেছে। একটু একটু করে ফেরীটা ক্রমাগতভাবে তীর ছেড়ে মাঝ নদীর দিকে ধাবিত হচ্ছে। এক ডিমওয়ালা ডিমডিম বলে চেচিয়ে গেল। বেচারার ব্যবসা ভাল যাচ্ছেনা। এক নাম্বার ফেরীঘাট প্রায় জনশুন্য অথচ সে যদি দুই নাম্বার ঘাটে থাকতো তাহলে তার ঝাকার সবগুলো ডিম এতোক্ষণে নিশ্চই শেষ হয়ে যেত। ওর কথা চিন্তা করে মনে হলো একটা ডিম খাওয়া যেতেই পারে। পনের টাকার একটা ডিম ক্ষুধা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। ক্ষুধা এতোটাই প্রবল হয়েছে যে ডিম থেকে আমি কতটুকু প্রোটিন পাব তার হিসেব না করে ডিমটা আমার ক্ষুধার কতটা নিবারণ করতে পারবে সেটাই মূখ্য বিষয় হয়ে দাড়াল। খরিদ্দার না পেয়ে ডিমওয়ালা নিচে নেমে গেল।
ভাবলাম পনের টাকার ডিম না খেয়ে বরং দশটাকার ঝালমুড়ি খেলে ক্ষুধা কিছুটা নিবারণ হবে। অপেক্ষায় থাকলাম কিন্তু কোন ঝালমুড়িওয়ালা এলোনা।সম্ভবত ঝালমুড়িওয়ালারা দুই নাম্বার ফেরী ঘাটে ওদিকটাকেই বেছে নিয়েছে।আমার মনে হলো যারা ফেরীতে ঝালমুড়ি বা ডিম বিক্রি করে তাদেরতো ফেরী বদলানোর দরকার পড়েনা। সব হয়তো ভাগ্য।এই ডিমওয়ালা কি ভাবতে পেরেছে যে এই ফেরীটা দুই নাম্বার ঘাটে না ভীড়ে এক নাম্বার ঘাটে ভীড়বে।ডিম কিংবা ঝালমুড়ি কোনটাই খাওয়া হয়নি বলে টাকাটা বেঁচে গেলেও সেটা আলাদা করে রাকিনি। এবার যেহেতু দামাদামি পযর্ন্ত যাইনি তাই ওটা আলাদা করা হয়নি। এভাবে সব কাজেই আলাদা করতে গেলে দেখা যাবে পুরো টাকাটাই আলাদা হয়ে গেছে।পুরো টাকা মানে কিন্তু বাদশাহ হুমায়ূনের রত্নভান্ডার নয়। বেতনের সাত হাজার টাকার সাথে বোনাস তিন হাজার টাকা মিলে মোট দশ হাজার টাকা। ফ্যাক্টরীতে আমার চেয়েও কেউ কেউ কম বেতন পায় এবং তারা কিভাবে সন্তান পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকে সেটা জানতে খুবই ইচ্ছে হয়।
ঈদ বলে টাকার পরিমান দশহাজারে ঠেকলেও খরচ এ সময়ে এতো বেশি হয় যে বলার নয়।মেসে থাকি।যে বুয়া রান্না করেন সেই বুয়াকে পঞ্চাশ টাকা বোনাস দিতে হয়েছে। যেখানেই যাচ্ছি সবার বোনাস চাই। যেন আমি একটা টাকার বস্তা নিয়ে বসেছি বোনাস দেব বলে।বাড়ি যাচ্ছি, খরচ হচ্ছে, আর তোমরাতো আমরা যাচ্ছি বলেই ইনকাম করতে পারছো তাহলে আবার বোনাসের দরকার কি। ঈদের মাস ছাড়া বাকি সময়টাতে বেতনের সাত হাজার টাকা দিয়েই চলতে হয়। হোটেল থেকে সকালে বিশ টাকা দিয়ে দুটো মোটা রুটি কিনে আনি। একটা রেখে দেই দুপুরের জন্য আরেকটা সকালে খাই। খাওয়ার আগে রুটিটাকে এক প্লেট পানির মধ্যে একটু লবন দিয়ে ভিজিয়ে রাখি।রুটিটা ভিজে মোটা হয়ে যায় এবং রুটি থেকে যেটা পানির সাথে মিশে যায় সেটাও খেয়ে ফেলি। বেশ ভাল ভাবেই পেট ভরে যায়। দুপুরেও ঠিক তাই করি। আর রাতে। নাহ বলতে গেলে কিছুই খাইনা। রাতেতো ঘুমিয়ে থাকি সুতরাং কোন কাজ কর্মহীন সময়ে খাবার খেয়ে লাভ কী। আর তাছাড়া ঘুমিয়ে থাকলে ক্ষুধাও লাগেনা। কিংবা ক্ষুধা লাগলেও টের পাওয়া যায়না। একান্তই খাওয়া লাগলে এক কাপ চায়ে একটা পাউরুটি ভিজিয়ে খাই। আমার কাছে মনে হয় পৃথিবীর সব থেকে মজার খাবার হল চায়ে পাউরুটি ভিজিয়ে খাওয়া।একবার আমার স্ত্রীকে কথাটা বলেছিলাম তার পর বেড়াতে গিয়ে সে পাউরুটি চা দিয়ে ভিজিয়ে খেয়ে বমি করার অবস্থা। সে বিছানায় শুয়ে রাতে আমায় প্রশ্ন করেছিল তুমি ওটা খাও কি করে? আমি নিবির্কার ছিলাম। আমারতো বেশ ভালই লাগে। ফেরী ঘাটে ভিড়তে বেশ দেরি। চা পাউরুটির কথা মনে পড়তেই ছাদ থেকে নেমে ক্যান্টিনে গিয়ে চা আর পাউরুটি খেয়ে নিলাম। দুপুর অব্দি তাহলে আর কিছু খাওয়া লাগবেনা।
হোটেলে বড় বড় গামলায় সাজিয়ে রাখা ইলিশের পেটিগুলো আমার দিকে তাকিয়ে সম্ভবত টিটকারি মারছিল।তবে পকেটে দশ হাজার টাকা থাকার পরও আমি সামান্য একটা পেটি দিয়ে ভাত খাচ্ছিনা কেন এটা যারা ভাবছেন তারা হয়তো জানেন না ওই পেটি দিয়ে ভাত না খাওয়ায় যে টাকাটা বাচবে সেটা দিয়ে আমার পুরো পরিবার এক বেলা খেয়ে থাকতে পারবে।
এইমাঝ রাতেও অনেকের মোবাইল মাঝে মাঝেই টুংটাং শব্দে বেজে উঠছে।বাড়ি ফিরছে দেখে হয়তো স্বজনেরা খুব উদ্বিঘ্ন হয়ে আছে। আমার ফোনে কেউ ফোন করার নেই। বউবাজার থেকে দুটো পুরোনো মোবাইল কিনেছিলাম আটশো টাকা দিয়ে। একটা বাড়িতে রেখে এসেছি আরেকটা আমার কাছে। খুব জরুরী না হলে ফোন করা হয় না। আগে থেকেই ঠিক করা আছে আমরা মোট তিন মিনিট কথা বলবো। এক মিনিট বউ পরিবারের খবর বলবে, এক মিনিট আমি নিজের কথা বলবো, আরেক মিনিট বাবা মা অথবা মেয়েটা কথা বলবে। এই মধ্য রাতে তারা কেউ জেগে নেই। ঘুম নষ্ট করে আমার জন্য বেহুদা চিন্তা করার কোন কারণও নেই। লোকে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কী এমন কথা বলে জানিনা।
ফেরী যখন ঘাটে ভিড়লো তখন রাত পৌনে দুইটা। ফেরী ঘাট থেকে বাস স্ট্যান্ড আধা কিলোমিটার দূরে। ওখান থেকে অটোতে গেলে দশটাকা ভাড়া নেবে সময় লাগবে পাঁচ মিনিট। আমি হেটেই রওনা হলাম। গোটা রাত পড়ে আছে আমার সামনে। আধা কিলোমিটার হাটতে বড়জোর বিশ মিনিট সময় লাগবে কিন্তু বেঁচে যাবে পুরো দশটা টাকা। এই মাঝ রাতে দশটাকা বাঁচানোটাও আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার।
অন্ধকার রাস্তায় আমি শুধু একাই হাটছিনা বরং আরো অনেকেই আছে। মনে মনে ভাবছি লোকে যে বলে আমি ছোটলোক তাহলে কি এরাও সবাই আমারই দলে। এদের সংখ্যাতো নেহাত কম নয়। বাসস্ট্যান্ডে এসে ঘুরে ঘুরে বাস খুঁজতে লাগলাম। এপারে কোন ট্রাকের বন্দ্যোবস্থ নেই সুতরাং দু’পাঁচ টাকা বেশি হলেও বাসেই যেতে হবে। হঠাৎ সাকায়েত ভাইয়ের সাথে দেখা। সে ড্রাইভার, আমাদের গ্রামেই বাড়ি। তাকে খুব ব্যতিব্যস্ত দেখাচ্ছে।ভাবলাম তার গাড়িতে যদি যেতে পারি হয়তো ভাড়া কিছু কম লাগবে কিন্তু সে এমন ভাব করলো যেন আমি তার গাড়িতে মাংনা যেতে চাইছি। মনটাই খারাপ হয়ে গেল।আল আমিনের সাথেও দেখা হলো, সেও গাড়ি চালায়। জিজ্ঞেস করলাম তোমার গাড়িতে সিট আছে কিনা। সে আমতা আমতা করে বললো কাকা ইঞ্জিন কভারে যেতে পারবেন দুইশো টাকা ভাড়া লাগবে। মনে মনে হিসেব করে দেখলাম দুইশো টাকা মানেতো অনেক।প্রায় পাঁচ কেজি চাল কেনা যাবে। আমি এদিকে ওদিকে খুঁজে খুঁজে একটা বাস পেলাম। ভাড়া সমান সমান তবে একটা সিট পেলাম।
পৌছাতে দুই আড়াই ঘন্টা লাগবে।সে সময়টাতে দু’চোখ বুজে ঘুমিয়ে নিলাম। বাসস্ট্যান্ডে নামার পর আমার করার মত কিছু থাকলো না। রাত তখন পৌনে চারটা বাজে। কেউ কেউ সেই রাতেই বাড়িতে চলে গেল। বিশেষ করে যাদের বাসা শহরেই। অন্য দিকে যাদের শহরে বাড়ি নেই তাদের অনেকেই শহরের কোন না কোন আত্মীয়র বাসায় থাকার জন্য চলে গেল। কারো কারো বাড়ি শহর থেকে দূরে হলেও চলে যেতে পারলো কারণ বাস থেকে নামলেই বাড়িটা হাটা দূরত্বে। আর আমার এই শহরে, এই রাতে যাওয়ার মত কোন বাসা নেই। বাস চলাচল করলেও গ্রামে যাওয়ার উপায় নেই। বাস আমাকে যেখানে নামিয়ে দেবে সেখান থেকে ভ্যানে করে দুই কিলোমিটার যাওয়ার পর আরো দুই কিলোমিটার হেটে যেতে হয়। বাস থেকে নেমে ঐ দুই কিলোমিটার যাওয়ার জন্য কোন ভ্যান পাওয়া যাবে না। সুতরাং রাত পোহানোর অপেক্ষায় বাসস্ট্যান্ডে একটা বেঞ্চিতে বসে থাকলাম। ভোর হলে তখন বাস ধরে রাড়ি ফেরা যাবে।
পাশে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে আমার মত দু’জন গার্মেন্টস কর্মী এসে বসলেন। মাত্র দু’মিনিটের মধ্যেই দোকানদার তাদের খুব আপনজন হওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।বিস্কুট,চানাচুর খেতে দিলেন, চা আনালেন। একটা টেবিল ফ্যান ছিল সেটাও তাদের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন।মহিলা দু’জন তার পুবর্পরিচিত ছিল না।পাশে যে আমিও জলজ্যান্ত একজন মানুষ বসে আছি তা সম্ভবত তার চোখেই পড়েনি।
আমি যে বেঞ্চিতে বসেছি সেখানে এক পাশে এসে বসলো এক সিগারেটখোর। মনের সুখে সিগারেটে টান দিয়ে ধোয়া ছাড়তে লাগলো। মন বলছিল লোকটাকে বলি ভাই অন্য কোথাও গিয়ে সিগারেট টানুন। পরে আর কথা বাড়ালাম না।অবশ্য একটু পরে তার সাথে অনেক কিছু নিয়ে কথা হলো।কিছুক্ষণ বাদে লোকটা উঠে চলে গেলে গার্মেন্টসকর্মী মহিলা দু’জন আমার সাথে গল্পে যোগ দিল।গল্পের বিষয়বস্তু একটু আগে উঠে যাওয়া সিগারেট খাওয়া লোকটি।সে বলেছে তার বাবার বয়স চল্লিশ পয়তাল্লিশ বছর হবে অথচ তার নিজের বয়সই পয়ত্রিশের উপরে।মহিলা দুজন অনেকটা রাগত স্বরে বললো বলদটা বলে কি! তার বাপ কি তাহলে পাঁচ বছর বয়সে বিয়ে করেছিল।পাঁচ বছর বয়সে কি বাবা হওয়ার ক্ষমতা থাকে?
বেতন ভাতা নিয়েও অনেক আক্ষেপ করলো। সামান্য ক’টা টাকা বেতন,ঢাকা থেকে আসতে যেতেই অনেক গুলো টাকা শেষ হয়ে যায়। পরিবারের লোকজন পরিস্থিতি বুঝতে চায় না, বিশেষ করে ছোটরা। তারা বায়না ধরলে আর রেহাই নেই। এদিক থেকে আমার মেয়েটা খুব ভাল। একটা টিভির শখ তার বহুদিনের। তবে কখনো নাছোড়বান্দার মত কেনার বায়না ধরেনি। কিছুক্ষনের মধ্যে বেঞ্চগুলো অপেক্ষমান মানুষে ভরে গেল।আমার মতই এদের সবার এ শহরে থাকার মত কোন যায়গা নেই। হোটেলে গিয়ে উঠবে সে সামর্থও নেই কারো। আবার এই রাতে গ্রামে যাবে সে অবস্থাও নেই। পথে চুরি ডাকাতির ভয় আছে। সামান্য পাঁচ সাত হাজার টাকা ছাড়া কারো কাছেই তেমন কিছু নেই। ঐ টাকাগুলো খোয়া গেলে ঈদের আনন্দ বিষাদে রুপ নিবে। তাই ঝুঁকি না নিয়ে ভোর হবার অপেক্ষায়।
সকাল হলে শহর থেকে মেয়ের জন্য একটা জামা আর স্ত্রীর জন্য একটা অল্প দামী শাড়ি কিনলাম। ঘরে বাবা মা আছেন। সারা বছর তাদেরকেও কিছু দেওয়া হয়না। এ জন্য অবশ্য স্ত্রী কন্যার মত তাদের মনেও তেমন কোন আক্ষেপ নেই। বাবা বলেন ‘ছোটলোকের ঘরে জন্মেছিস পোড়া কপাল নিয়ে, তাই সারা জীবন কষ্ট করতে হচ্ছে’। আমি কিছু বলতে পারি না। আমার স্ত্রী বাবার পাশে দাড়িয়ে শান্তনা দিয়ে বলে বাবা অমন কথা বলবেন না। দেখবেন নিশ্চই একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা মূখে হাসি টেনে বলেন তোমার মত একজনকে পরিবারের সদস্য হিসেবে পেয়েছি বলেই কিছুটা শান্তি। স্ত্রী কন্যার কাপড় কেনার পাশাপাশি বাবার জন্য পাঞ্জাবী আর মায়ের জন্য শাড়ী কিনলাম। ঢাকা থেকে কিনতে পারতাম কিন্তু সেরকম সময় ছিল না। আর তাছাড়া ঢাকায় জিনিসপত্রের দাম বেশি। সবার কাছেই গরম টাকা থাকে। সেই চিন্তা করে নিজের শহর থেকে কেনা।
ঈদের দিন সকালে মেয়েটার হাতে দুটো বিশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলাম। সারা বছর কিছুইতো দেওয়া হয় না। টাকাটা হাতে নিয়ে সে নেড়েচেড়ে দেখলো।তার পর জামার পকেটে রেখে দিল।তার মূখে তখন দারুন খুশির আভা। আমি মেয়েটার হাসিমূখ দেখে নামাজে গেলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম সামান্য টাকা দিয়ে ও কি কি কিনবে। নামাজ শেষে খেতে বসেছি, মেয়েটাও পাশে বসেছে। তার হাতে তখন গত বছর বৈশাখী মেলা থেকে কেনা মাটির ব্যাংকটা। পকেট থেকে একটা বিশটাকার নোট, একটা দশটাকার নোট আর কয়েকটা দুইটাকার নোট বের করে একটা একটা করে সে তার মাটির ব্যাংকে ভরতে লাগলো। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম তুমি কিছু খাওনি? সে বললো বাবা খেয়েছিতো। চার টাকার পিয়াজু কিনেছিলাম। আমি খেয়েছি, দাদা দাদিকে দিয়েছি, মাকেও দিয়েছি। তোমার জন্য রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু মা বললো পিয়াজু খেলে তোমার নাকি পেটে সমস্যা হয় তাই বাকিটাও খেয়ে ফেলেছি। আর এই বেঁচে যাওয়া টাকাগুলো জমাচ্ছি যদি একটা টিভি কেনা যায়। মেয়ে আমার অসময়ে জন্মেছে। ওর জন্মানো উচিত ছিল শায়েস্তা খার আমলে যখন টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেত বলে শুনেছি।
বাবার বলা সেই পুরোনো কথাটা খুব মনে পড়ে গেল। ছোটলোকের ঘরে জন্মেছিস পোড়া কপাল নিয়ে। আমার মেয়টাওতো জন্মেছে আমার ঘরে। তাকে আমি কোন ভাবেই ছোটলোক ভাবতে চাই না। যার মন এতো বড় সে কখনো ছোটলোক হতে পারে না। ঈদের পরদিন মেয়েটা জ্বরে পড়লো। জ্বরে ওর সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছিল। একটা ভ্যানে করে বিনোদপুর বাজারে ফুলমিয়া ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার সব দেখেশুনে সদরে পাঠিয়ে দিলেন।
অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে জানা গেল মেয়ের ম্যালেরিয়া হয়েছে। চিকিৎসায় এ রোগ ভাল হয়। ঈদের বাজার সদাই করার পর যৎসামান্য টাকা ছিল হাতে। তা দিয়ে মেয়ের চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। গ্রামের মধ্যে অর্থ বিত্ত সম্পন্ন লোকের অভাব নেই। কায়েকজনের কাছে ধার চাইতেই তারা নানা অজুহাত দেখালো। শেষে গেলাম সুজাউদ্দিন চাচার বাড়িতে। গ্রামের সব থেকে টাকাওয়ালা সে। মেয়ের অবস্থার কথা বলে কিছু টাকা ধার চাইলাম। তিনি জানালেন দেবার মত টাকা তার হাতে নেই। থাকলে নিশ্চই দিতেন। আমি তার কাছে শ্রেফ ধার চাইতে গিয়েছি তাই সেখানে জোর করার কিছু নেই।
যখন খালি হাতে ফিরছি তখন দেখলাম তার বড় ছেলে এসে তার কাছে টাকা চাইতেই পকেট থেকে বেশ কিছু টাকা বের করে দিলেন। কত টাকা জানি না, তবে পাঁচ দশ হাজারের কম নয়। টাকার জোগাড় অবশ্য পরে করেছিলাম স্ত্রীর কানের দুল বিক্রি করে। শেষপযর্ন্ত কিছু হয়নি। মেয়েটা তিনদিনের জ্বরে ভুগে সব মায়া কাটিয়ে চলে গেল। বাবা,মা, স্ত্রী শোকে পাথর হয়ে গেল, আমিও। মেয়েটা ক্লাস ফাইভে পড়তো। হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর। সে নেই, তার স্মৃতি রয়ে গেছে। ওর একটা খাতা হাতে নিয়ে ওল্টাতে থাকি। মাঝখানে চিঠির মত করে লেখা। ‘বাবা আমি যে মাটির ব্যাংকটাতে টাকা জমাই সেটা দিয়ে আমি কিন্তু কোন টিভি কিনবো না।যদিও আমি তোমাকে বলেছি টিভি কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছি। টিভি না দেখলেতো আমরা মরে যাব না। আমি টাকা জমাই অন্য কারণে। তুমি ঢাকাতে থাক। বাড়িতে মা আমি আর দাদা দাদি থাকি। মায়ের হাতে তুমি যে টাকা গুলো দাও তা দিয়ে পুরো মাস চলে না। তুমি যখন থাকো না তখন যদি কারো অসুখ হয় আমরা টাকা পাব কোথায়? সে কথা ভেবেই আমি টাকা জমাই। বিপদের দিনে যদি কাজে লাগে’।
চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। খাতাটা বন্ধ করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরি।যেন খাতাটা নয় মেয়েকেই জড়িয়ে রাখছি। ওর মাটির ব্যাংকটা বইখাতার পাশেই ছিল। এক হাতে ব্যাংকটা সামনে মেলে ধরি।এর সবগুলোতে আমার মেয়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ওইটুকু ছোট্ট মাটির ব্যাংকে কতটাকা জমা হয়েছে তা দেখার দরকার নেই। ব্যাংকটা আজীবন ওভাবেই রেখে দিতে চাই।
ছুটি শেষ হয়ে গেছে কিন্তু শোক শেষ হয়নি। এক জীবনে এই শোক শেষ হবার নয়। বাবা মাকে স্ত্রীর হেফাজতে রেখে আবার ঢাকার পথে রওনা হই। ঈদে বাড়ি ফোরর মতই অবস্থা। তবে যাওয়ার সময় কিছু সুখ সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম সেই সাথে কিছু সুখের মুহুর্ত কাটানোর স্বপ্ন ছিল।আর ফেরার সময় একবুক বেদনা নিয়ে যাচ্ছি। ভাবছি অফিসের বড় স্যারদের বলে স্ত্রীর জন্য যদি একটা কাজ জোগাড় করতে পারি তাহলে বাবা মাকে ঢাকায় নিয়ে আসা যাবে। আমাদের দু’জনের উপার্জনে নিশ্চই দু’বেলা খেয়ে পরে বেঁচে থাকা যাবে।
মেয়েটা মারা যাবার তিন মাস পর বাবা মা স্ত্রীকে ঢাকায় নিয়ে এসেছি। ওর জন্য আমাদের ফ্যাক্টরীতেই একটা কাজের ব্যবস্থা করেছি। দুই রুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি মাজার রোডের কাছে। ভাড়া সাড়ে চার হাজার টাকা।দু’জনের মোট বেতন থেকে ভাড়া মিটিয়ে যা থাকে তা দিয়ে চারজনের কোন মতে বেঁচে থাকা হবে। এর মাঝে আমাদের বড় স্যার খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন।ঢাকার নামকরা এক হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। একদিন তাকে দেখতে গেলাম। হঠাৎ দেখা হলো আমাদের গ্রামের সব থেকে বড়লোক সুজাউদ্দিন চাচার সাথে। তিনি এ হাসপাতালে কেন তা বুঝতে পারিনি। তাকে দেখে এগিয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম কার কি হয়েছে। শুনলাম তার একমাত্র ছেলের হার্টের অপারেশান আজই কিন্তু কোন ভাবেই তার গ্রুপের রক্ত পাওয়া যাচ্ছেনা।আমি বললাম চাচা রক্ত তো কিনতে পাওয়া যায়।আপনারতো টাকার অভাব নেই। আমরা না হয় ছোটলোক, আমাদের সমস্যা হতে পারে কিন্তু আপনাদেরতো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
তিনি ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।তাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল।আমি তাকে শান্তনা দেবার ভাষা খুঁজে পাইনি। বড় স্যারকে দেখার জন্য সুজাউদ্দিন চাচার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তার আগে জানলাম তার ছেলের ও নেগেটিভ রক্ত লাগবে কিন্তু এই গ্রুপের রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। আর এক ঘন্টার মধ্যে অপারেশান করতে না পারলে খুব অসুবিধা হয়ে যাবে। আমি বিদায় নিয়ে সামনের দিকে হাটতে হাটতে ভাবতে লাগলাম যে গ্রুপের রক্ত সহজে পাওয়া যায় না সেই গ্রুপের রক্ত আল্লাহ কেন সৃষ্টি করলেন।
বড় স্যারকে যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে যেতে হলে নিজের পরিচয় দিতে হচ্ছে। কোম্পানী থেকে দেওয়া আইডি কার্ডটা দেখালাম। আমাকে ঢুকতে দিল। আইডি কার্ডটা ফিরিয়ে নিয়ে যখন পকেটে রাখতে যাব তখন আশ্চর্য হয়ে দেখলাম আমার আইডি কার্ডে রক্তের গ্রুপ লেখা ও নেগেটিভ। চাকরিতে ঢুকার সময় রক্ত পরীক্ষা করেছিল সে কথা মনেই ছিল না। আমি দ্রুত নেমে গেলাম। সুজাউদ্দিন চাচার ছেলের জন্য রক্ত দিতে এসেছি বলার পর তারা আমার রক্ত নিল।সুজাউদ্দিন চাচা এমন কেউ নন যে তার নাম বললেই হাসপাতালের সবাই চিনবে।আমি কাউন্টারে গিয়ে রোগীর নাম, বাবার নাম এবং রক্তের গ্রুপ বলায় তারা আমার থেকে রক্ত নিতে সম্মত হয়েছে।
আমি রক্ত দিয়ে যখন বের হচ্ছি তখন সুজাউদ্দিন চাচা কাউন্টারে দাড়ানো।তার মুখে কিছুটা স্বস্তির চিহ্ন।কাউন্টারের লোকটা আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন ইনিই আপনার ছেলের জন্য রক্ত দিয়েছেন। সুজাউদ্দিন চাচার চোখ ছলছল করে উঠলো।
আমি কোন কিছু পাত্তা না দিয়ে হন হন করে বেরিয়ে আসলাম। তিনিও আমার পিছনে পিছনে আসতে লাগলেন। হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিলেন আমি সে সুযোগ দেইনি। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাস ধরে ফিরে এসেছি। মনে মনে হাসতে হাসতে বলেছি ছোটলোকের রক্ত শরীরে বয়ে বেড়াক সুজাউদ্দিনের ছেলে। যদিও ওই রক্ত মিশে গিয়ে বাকি রক্তটুকু বদলে দিতে পারবেনা। সুজাউদ্দিন চাচা কিংবা তার ছেলের সাথে আর কখনো দেখা হয়নি বলে জানা হয়নি ছোটলোকের রক্ত নিয়ে সে সুখে আছে কিনা।
২ আগষ্ট ২০১৭
১ সেপ্টেম্বর ২০১৭
[url=https://drugs1st.com/#]offshore pharmacy no prescription[/url] online pharmacy no presc uk
buy accutane 20mg pill purchase accutane buy prednisone 5mg online
https://drugs1st.com/# canadian pharmacy coupon code
online pharmacy same day delivery canadian pharmacy meds
order piracetam 800 mg pills sildenafil 100mg england viagra 100mg england
https://drugs1st.com/# pharmacy online 365 discount code
[url=https://drugs1st.com/#]canadian online pharmacy no prescription[/url] canadadrugpharmacy com
buy azithromycin 250mg generic buy zithromax pill order neurontin 600mg online cheap
canadian pharmacies not requiring prescription online pharmacy without scripts
[url=https://drugs1st.shop/#]us online pharmacy[/url] cialis canadian pharmacy
https://drugs1st.shop/# discount pharmacy
order cialis 10mg pills viagra 100mg usa buy sildenafil 50mg sale
big pharmacy online canadian mail order pharmacy
https://drugs1st.shop/# canadian pharmacy 24h com safe
[url=https://drugs1st.com/#]canadian pharmacy without prescription[/url] indian pharmacy
furosemide cost buy doxycycline online cheap buy hydroxychloroquine 200mg without prescription
purchase cialis betnovate tablet purchase clomipramine generic
https://drugs1st.com/# canadian pharmacy sildenafil
[url=https://drugs1st.shop/#]us online pharmacy[/url] canadian king pharmacy
cheap chloroquine chloroquine 250mg us baricitinib 4mg canada
https://drugs1st.com/# the pharmacy
[url=https://drugs1st.com/#]top mail-order pharmacies in usa[/url] american pharmacy
order sporanox 100mg pill sporanox price buy tindamax for sale
We can see that we need to develop policies to deal with this trend.
[url=https://prednisone1st.store/#]buy prednisone canadian pharmacy[/url] prednisone without prescription 10mg
buy ciprofloxacin antibiotics cipro
Great post, keep up the good work, I hope you don’t mind but I’ve added on my blog roll.
Hello.This article was extremely interesting, particularly since I was searching for thoughts on this subject last couple of days.
buy glucophage 500mg generic buy tadalafil 10mg pills cost tadalafil 5mg
A colleague in the field told me to check out your website.
[url=https://zithromax1st.store/#]generic zithromax 500mg india[/url] zithromax prescription
can i buy amoxicillin over the counter amoxicillin without a prescription
brand olanzapine bystolic pill buy valsartan 80mg
[url=https://zithromax1st.store/#]azithromycin zithromax[/url] cost of generic zithromax
generic norvasc 5mg buy viagra pill tadalafil us
prednisone 4mg prednisone steroids
Great resources and tips for families here.
[url=https://amoxil1st.store/#]how to get amoxicillin[/url] buy amoxicillin without prescription
clozapine 50mg price clozapine pill dexamethasone 0,5 mg canada
prednisone tablets india prednisone 5 mg tablet
viagra 25mg price order lisinopril 10mg online buy lisinopril 10mg generic
[url=https://zithromax1st.store/#]zithromax price south africa[/url] zithromax antibiotic
buy generic doxycycline doxycycline price 100mg
cheap zyvox 600 mg casino games best real casino online
Thanks for discussing the issues and covering them in a well written format.
My coder is trying to convince me to move to .net from PHP. I have always disliked the idea because of the expenses. But he’s tryiong none the less. I’ve been using WordPress on numerous websites for about a year and am nervous about switching to another platform. I have heard great things about blogengine.net. Is there a way I can import all my wordpress posts into it? Any help would be really appreciated!
[url=https://clomid1st.science/#]clomid otc[/url] clomid tablets australia
I am glad to be a visitor of this perfect blog !, appreciate it for this rare info!
buy omeprazole 10mg pills pay for essay free spins no deposit casino
Thanks For This Blog, was added to my bookmarks.
https://prednisone1st.science/# 20 mg prednisone tablet
[url=https://propecia1st.science/#]propecia pills[/url] propecia 1mg tablets
best ed pills non prescription what is the best ed pill
[url=https://propecia1st.science/#]propecia hair loss[/url] buy propecia 5mg
order lopressor 50mg pills order metoprolol 100mg for sale levitra 20mg over the counter
https://clomid1st.science/# clomid fertility drug
non prescription ed pills what is the best ed pill
[url=https://prednisone1st.science/#]prednisone 20 mg in india[/url] prednisone 500 mg tablet
my family essay writing parx casino online free slot machine games
clomidmedication.co.uk 50 mg clomid capsules
[url=https://prednisone1st.science/#]prednisone 20mg prices[/url] where can i get prednisone over the counter
https://clomid1st.science/# cheap clomid free shipping
brand vardenafil 10mg buy vardenafil 10mg methylprednisolone order
finasteride prostate propecia hair
[url=https://propecia1st.science/#]buy propecia online cheap[/url] finasteride prostate
write essays online writing paper online viagra 100mg pills
Our communities really need to deal with this.
We absolutely love your blog and find the majority of your post’s to be exactly what I’m looking for. Do you offer guest writers to write content to suit your needs? I wouldn’t mind composing a post or elaborating on a number of the subjects you write about here. Again, awesome weblog!
[url=https://propecia1st.science/#]generic propecia cheap[/url] propecia purchase
cheap propecia generic cheap propecia canada
clomid 100mg ca gambling sites play online blackjack for real money
https://prednisone1st.science/# how can i order prednisone
[url=https://propecia1st.science/#]buy propecia no prescription[/url] propesia
legitimate online pharmacies india secure generic pills
cialis 20mg us buy cialis canada viagra generic
triamcinolone 10mg ca desloratadine 5mg sale buy clarinex 5mg for sale
https://withoutprescriptions.store/# legitimate canadian pharmacy online
Hi there! I just wanted to ask if you ever have any trouble with hackers? My last blog (wordpress) was hacked and I ended up losing several weeks of hard work due to no back up. Do you have any solutions to protect against hackers?
Well done! Keep up this quality!
onlinepharmaciescanada com medicine without dr prescription
Definitely what a great blog and instructive posts I definitely will bookmark your site.All the Best! https://no19butik.com/
canadian pharmacy viagra 100mg overseas pharmacies without an rx
Thank you for great article. I look forward to the continuation. https://farmasiucretsizuyelik.com/
dapoxetine 90mg brand cheap levothyroxine generic purchase levothyroxine pill
https://indiapharmacy.store/# india pharmacy mail order
tadalafil max dose cialis price walmart viagra 25mg for sale
recommended canadian pharmacies https://canadianpharmacy.icu/# canadian drugstore online
https://indiapharmacy.store/# cheap ed pills from india
There most be a solution for this problem, some people think there will be now solutions, but i think there wil be one.
Sometimes, the sheer magnitude of the information seems overwhelming.
I wrote down your blog in my bookmark. I hope that it somehow did not fall and continues to be a great place for reading texts.
You are not right. I am assured. I can prove it. Write to me in PM, we will talk.
oral orlistat 120mg purchase orlistat online cheap acyclovir 400mg canada
cialis 10mg for sale cialis online canada clopidogrel 150mg usa
This is really interesting, You’re a very skilled blogger. I have joined your feed and look forward to seeking more of your great post. Also, I’ve shared your web site in my social networks!
https://withoutprescriptions.store/# levitra from canadian pharmacy
order allopurinol 100mg generic rosuvastatin 10mg uk zetia order online
purchase methotrexate order methotrexate 2.5mg generic order reglan 10mg generic
domperidone over the counter motilium without prescription flexeril 15mg drug
Greetings, have tried to subscribe to this websites rss feed but I am having a bit of a problem. Can anyone kindly tell me what to do?’
buy generic cozaar 50mg buy esomeprazole 20mg pill buy topiramate 100mg generic
[url=https://datingonline1st.com/#]free dating service[/url] thai flirt
https://datingonline1st.shop/# skip the games dating site free
order baclofen 25mg without prescription order toradol 10mg toradol oral
[url=https://datingonline1st.com/#]japanese dating sites[/url] free text dating services
Cherished is likely to be what people say about your comments.
colchicine over the counter order colchicine 0.5mg for sale pala casino online
I don’t know if it’s just me or if everybody else experiencing issues with your site. It appears as though some of the written text on your content are running off the screen. Can someone else please provide feedback and let me know if this is happening to them as well? This could be a problem with my web browser because I’ve had this happen before. Appreciate it
https://datingonline1st.shop/# absolutely free dating sites
best over the counter yeast treatment oral thrush treatment over the counter
[url=https://drugsoverthecounter.shop/#]pills like viagra over the counter cvs[/url] over the counter anti inflammatory
https://drugsoverthecounter.shop/# over the counter medicine for uti
Oh my goodness! an amazing article. Great work.
uhc over the counter essentials 2019 best over the counter cough medicine
free roulette games play casino games for cash play online blackjack
[url=https://drugsoverthecounter.com/#]walgreens sleep aids over the counter[/url] over the counter ringworm treatment
order generic flomax 0.2mg cost zofran 4mg order spironolactone online
best allergy medications over-the-counter muscle relaxer over the counter
[url=https://drugsoverthecounter.com/#]over the counter pill for yeast infection[/url] over the counter erectile pills at walgreens
https://drugsoverthecounter.com/# over the counter yeast infection treatment
cialis 20mg brand ampicillin for sale online buy cipro 500mg for sale
https://drugsoverthecounter.com/# uti over the counter medication
strongest antifungal over the counter sleeping pills over the counter
zocor over the counter finasteride for sale online order propecia 5mg for sale
generic metronidazole 200mg bactrim cheap buy bactrim 480mg pill
over the counter adderall best over the counter skin tag removal
[url=https://drugsoverthecounter.com/#]rightsourcerx over the counter[/url] over the counter muscle relaxers
Nice read, I just passed this onto a colleague who was doing some research on that. And he just bought me lunch as I found it for him smile Therefore let me rephrase that: Thank you for lunch!
order keflex 500mg purchase cleocin pills order erythromycin 500mg without prescription
over the counter medicine for anxiety and stress over the counter stocks